পারমিতা প্রধান, অস্ট্রেলিয়া: আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বসবাস করছি। এই ১৫ বছরে বেশিরভাগ সময়ই পুজো কেটেছে দেশের বাইরে। আজ তোমাদের সঙ্গে পার্থের দুর্গাপুজোর গল্প ভাগ করে নেব। ২০১০ সালে যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন এখানে মাত্র একটা পুজো হত। এখন প্রায় ৩-৪টি পুজো হয়। তাই কিছুটা হলেও মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরার স্বাদ পাওয়া যায়। আমরা শুরু থেকেই বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (BAWA)-র সঙ্গে যুক্ত। এটি পার্থের প্রাচীনতম দুর্গাপুজো। প্রায় ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।
এখানে পুজো দেশের মতো নির্দিষ্ট তিথি মেনে হয় না। কারণ ছুটি পাওয়া যায় না। তাই আমাদের নিয়ম অনুযায়ী, শুক্রবার সন্ধ্যায় ষষ্ঠী। শনিবার সকালে সপ্তমী। বিকেলে অষ্টমী। রবিবার সকালে নবমী ও দশমী। আর সন্ধ্যায় বিজয়া সম্মেলনী।
এখানে প্যান্ডেল বাঁধা হয় না। কারণ পুজো হয় কমিউনিটি হলে। এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় মঞ্চ সাজানোর পরিকল্পনা। রং-তুলির টানে প্রতি বছর নতুনভাবে তৈরি হয় ব্যাকড্রপ। প্রতিবছর নতুন প্রতিমা আনা হয় না। ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা একবার বানিয়ে আনলে ৫-৮ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। পুজো শেষে প্রতিমাকে বাক্সবন্দি করে রাখা হয় স্টোর রুমে। পরের বছরের অপেক্ষায়।
শুক্রবার সকালে স্টোর রুম থেকে প্রতিমা আনা হয়। বিকেলের মধ্যেই মঞ্চ সাজানো হয়ে যায়। প্রতি বাঁচার ভক্তিভরে পুজো করা হয়।
পুজো মানে দেদার খাওয়াদাওয়া। তাই মেনুতে থাকে রকমারি খাবার। ঠাকুরে মণ্ডপে থাকা পর্যন্ত নিরামিষ খাবারই খাই। ষষ্ঠীতে লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম, হালুয়া। সপ্তমীতে খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি। অষ্টমীতে ফ্রায়েড রাইস, পনির, ভেজিটেবল কারি। নবমীর দুপুরে ভাত, ডাল, পোস্ত, ডালের বড়া। কখনও দই বেগুনও হয়। বিজয়ার সন্ধ্যায় ভাত ও খাসির মাংস। প্রতিদিনই মেনুতে থাকে ঘরে তৈরি মিষ্টি ও মিষ্টি দই। এই সবকিছুই বানানো হয় কমিউনিটি কিচেনে। কমিউনিটির সদস্যরাই তৈরি করেন। গত বছর ছানা বানিয়ে প্রায় ৭০০টা রসগোল্লা তৈরি হয়েছিল দু’দিন ধরে।
গত দু’বছর ধরে কলকাতার স্ট্রিট ফুডের স্বাদ আনতে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বসে ফুচকার স্টল। ২০০ জনকে ১২০০ ফুচকা পরিবেশন করা সহজ নয়। তা সত্ত্বেও মশলা থেকে টকজল বানানো, সার্ভ করা – সবই ভালোবেসে করেন কমিউনিটির সদস্যরা। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০ জন অংশ নেন। সপ্তমীর সন্ধ্যায় সংখ্যা পৌঁছয় অন্তত পাঁচশোতে। তখন শুধু বাঙালি নয়। অনেক অবাঙালিও যোগ দেন পুজোয়। ওই আড়াই দিন আমরা শুধু বাড়ি যাই পোশাক বদলাতে আর ঘুমোতে। বাকি সময় কেটে যায় কমিউনিটি সেন্টারে। দেদার খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, আর সবাই মিলে কাজ করা-এই নিয়েই চলে পুজো।
অষ্টমীর সন্ধ্যায় হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। গত বছর ছোটরা মিলে পরিবেশন করেছিল ‘পেটপুজো’ থিমে একটি অনুষ্ঠান-ভজহরি মান্না, বাংলা আমার সরষে ইলিশ, দামোদর শেঠের কবিতা-সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবেশ।
রবিবার সকালে একসঙ্গে হয় নবমী ও দশমী। যার অন্যতম আকর্ষণ ঠাকুর বরণ ও সিঁদুর খেলা। সিঁদুর খেলা ও ঢাকের তালে নাচে অন্তত ১০০-১৫০ জন বিবাহিতা মহিলা অংশ নেন। তখনই মনে পড়ে যায় বিদায়ের সুর। প্রতিমা যখন বাক্সে ঢোকে মনে মনে বলি-আসছে বছর আবার এসো।
বিজয়া সম্মেলনীর দিন কমিউনিটির সদস্যরা মিলে ছোটখাট অনুষ্ঠান করেন। কখনও ফ্যান্সি ড্রেস, কখনও বাচ্চাদের নাচ, গান, কবিতা বা বাদ্যযন্ত্র। গল্প আর বিজয়ার শুভেচ্ছায় ভরে ওঠে সন্ধ্যা। আর শেষে বাঙালির প্রিয় খাসির মাংস আর ভাত দিয়ে ডিনার – এভাবেই শেষ হয় বছরের মতো পুজো।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.