দুর্গাপুজোর বাকি আর কয়দিন। প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে চেনা পাড়া। রাতে নিজের গলি চিনতে ভুল হচ্ছে তা বলতে দ্বিধা নেই অনেকেরই। সাত সমুদ্র পাড়ে মার্কিন নগরেও লেগেছে সেই ছোঁয়া। অ্যারিজোনার শহর ফিনিক্সের ‘সংহিতার’ ১২ বছরের পুজোয় গঙ্গাপাড় থেকে গিয়েছে নতুন প্রতিমা। কলম ধরলেন সংহিতার সদস্য সিনিয়র গবেষক সৌম্যদেব সরকার।
২০০০ সাল থেকে দুর্গাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। প্রথমে (২০০১–২০০৪) শ্যামপুকুর স্ট্রিট সর্বজনীনের সংগঠক হিসেবে। তারপর ২০০৫–২০১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন শারদ সম্মানের বিচারকের ভূমিকায়। এই সময়কালের অভিজ্ঞতা বর্ণময়। তাই ২০১৯ সালে যখন আমেরিকায় যাওয়ার ডাক এল, তখন মাথায় প্রথমেই ভেসে উঠল— পুজোয় কলকাতা ছেড়ে দূরে, কীভাবে কাটবে দুর্গাপুজো?
কাট টু ২০২৫। অ্যারিজোনায় এটা আমার তৃতীয় বছর পুজো কাটানোর অভিজ্ঞতা। প্রথম পুজো (২০২৩) ছিল সহ-সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটি উপলক্ষ। সেই সময় থেকেই পুজো কমিটির ইচ্ছা জেগে ওঠে সময় এসেছে নতুন দুর্গা আনার। ২০২৪-এর দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নতুন প্রতিমার খোঁজ। সংগঠকদের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব অর্পিত হয় প্রতিবেদকের উপরেই। দায়িত্ব দেওয়া হয় কুমোরটুলির শিল্পী প্রশান্ত পালকে। যিনি ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা গড়ায় সিদ্ধহস্ত। ২০২৫-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে তৈরি হলেন মা। সম্পূর্ণ হল চক্ষুদান। পরানো হল বেনারসি শাড়ি আর উপযুক্ত অলংকার। দেবীর সঙ্গে তৈরি হলেন তাঁর সন্তানরাও। বিশাল কার্গো জাহাজে যাত্রাপথ ছিল দীর্ঘ। পাড়ি দিতে হল প্রায় ১৭,০২৪ কিলোমিটার। চেন্নাই, সিঙ্গাপুর, টোকিও হয়ে, সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবশেষে মে মাসের ১১ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরে ভিড়ল ‘সংহিতা’র নতুন দুর্গা। এরপর লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সড়কপথে ফিনিক্স শহরে পৌঁছলেন আমাদের উমা।
অ্যারিজোনার রাজধানী ফিনিক্সে ‘সংহিতা’র দুর্গোৎসব এ বছর অনুষ্ঠিত হবে ২৬ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর। প্রবাসী বাঙালিদের এই কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজো এবার দ্বাদশ বর্ষে পদার্পণ করছে। ফিনিক্স শহরের অন্যতম জনপ্রিয় দুর্গোৎসব এটাই। তবে সংহিতার পরিচয় কেবল পুজোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারা বছরজুড়ে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমেও সংগঠনটি প্রবাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। কোভিড মহামারীর সময় সহায়তা, আর্থিক অনুদান কিংবা শিশুদের খাদ্য জোগান, সব ক্ষেত্রেই ‘সংহিতা’ তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে এসেছে।
সংহিতার দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার পুজোর দিনগুলির কাছাকাছি কোনও এক সপ্তাহান্তে। শুক্রবার থেকে রবিবার উৎসব চলে তিনদিন। প্রস্তুতি শুরু হয় প্রায় তিন মাস আগে থেকেই। শুধু পুজোর প্রস্তুতি নয়। সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা আর সৃজনশীল আয়োজন মিলিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে উৎসবের আবহ। সেই পরিশ্রমের ফসল প্রকাশিত হয় বার্ষিক স্মরণিকা ‘সংস্কৃতি’-তে, যেখানে স্থান পায় সদস্যদের লেখা কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি ও নানা সৃজনশীল রচনা।
মহাষষ্ঠীর আচারপর্বের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় পুজোর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টোরেজ থেকে প্রতিমাকে আনা হয় সুসজ্জিত মণ্ডপে। মহাসপ্তমীতে কলাবউ স্থাপনের পর সন্ধ্যায় আয়োজিত হয় জমজমাট ‘বলিউড নাইট’। যেখানে কলকাতা ও মুম্বই থেকে আগত শিল্পীদের গানে মেতে ওঠেন সকলে। মহাষ্টমীর সকালে পুষ্পাঞ্জলি ও খিচুড়ি ভোগে ভরে ওঠে ভক্তদের মন। বাজতে থাকে ঢাক, শঙ্খ, কাঁসর—তার সঙ্গে মিশে যায় উলুধ্বনিও। সন্ধ্যায় হয় বিশেষ পুজো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে ছোটদের নাটক, বড়দের নৃত্য ও গান মঞ্চে প্রাণসঞ্চার করে। শেষ দিন মহানবমীর অঞ্জলি ও ভোগের পর হয় কুমারী পুজো যেখানে ফিনিক্সের কন্যারা দেবীর রূপে পূজিত হন এদিন। এরপর ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা এবং সবশেষে সিঁদুর খেলায় মিলেমিশে যায় আবেগ, আনন্দ ও বিদায়বেলার স্নিগ্ধতা। মহিলাদের সিঁদুর বিনিময় আর পুরুষদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে শেষ হয় তিনদিনের মহোৎসব।
কেবল ধর্মীয় আচার নয়, ভোজনও সমান গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই উৎসবের। ‘সংহিতা’র পুজোর মেনুতে থাকে বাঙালির প্রিয় সব স্বাদ। শাহি পনির, মালাই কোফতা থেকে শুরু করে মাছের চপ, চিকেন কারি কিংবা মটন কষা। আর ভোজের পূর্ণতা পায় দই ও রসগোল্লা দিয়ে। সব মিলিয়ে সংহিতার দুর্গোৎসব আজ কেবল অ্যারিজোনার বাঙালিদের নয়, ফিনিক্সের বহুসাংস্কৃতিক প্রবাসী সমাজের কাছেও বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প ও ভোজন মিলেমিশে তৈরি হয় এক অনন্য মিলনমেলা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.