প্রতীকী ছবি
বিশ্বদীপ দে: ‘প্রথম মানুষ কবে এসেছিল এই সবুজ মাঠের ফসলের উৎসবে!’ লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। শিল্পী-বিজ্ঞানী-লেখক-গবেষক থেকে শুরু করে কল্পনাপ্রবণ মানুষেরা বারবার সময়ের জানলায় চোখ রেখে চিনে নিতে চেয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষদের। কিন্তু হারানো সময়কে চেনার ‘চকমকি পাথর’ কি চাইলেই পেলে? কখনও আলতামিরার গুহার বাইসন, কখনও আদিম মানুষের অস্থিমজ্জা… প্রত্নতত্ত্ববিদরা সব কিছুর ভিতরেই খুঁজে বেড়ান আদিম মানবের কবেকার সুখ-দুঃখ-রোমাঞ্চ! সম্প্রতি সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার আদিম মানুষদের আঙুলের ছাপ! যে ছাপে অতীতের স্পর্শ একেবারে জ্যান্ত হয়ে দেখা দিচ্ছে চোখের সামনে।
দক্ষিণপশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার গুনাইকার্নাই কান্ট্রিতে অবস্থিত নিউ গিনি-২ গুহা। চুনাপাথরের ওই গুহার অন্দরে আবিষ্কৃত হয়েছে আদিম মানুষের আঙুলের ছাপ। নরম, উজ্জ্বল গুহাগাত্রে যেখানে প্রাকৃতিক আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ… সেখানেই এমন ছাপ দেখা গিয়েছে। সব মিলিয়ে সাড়ে নশোরও বেশি আঙুলের ছাপ। যেন অতীতের এক সেতু। যা বেয়ে যেতে পারলে চোখের সামনে ফুটে উঠবে আদিম মানুষের কবেকার দিনযাপনের এক টুকরো! কিছুদিন আগে ‘অস্ট্রেলিয়ান আর্কিওলজি’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই সংক্রান্ত গবেষণার কথা জানা গিয়েছে। আর তারপর থেকেই ওয়াকিবহাল মহলে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।
ভিক্টোরিয়ান আল্পসের পাদদেশে অবস্থিত এই গুহায় যাওয়ার পথ সবুজ লতাগুল্মে ঘেরা। গুনাইকার্নাই ল্যান্ড অ্যান্ড ওয়াটার্স আবোরিজিনাল কর্পোরেশনের নেতৃত্বে গবেষকদের দল সেখানে পৌঁছয়। মনাশ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্পেন-ফ্রান্স-নিউজিল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দলও এই অভিযানে অংশ নিয়েছিল। গুহার গভীরে প্রবেশ করার পর সকলেই হাঁ হয়ে যান দেওয়াল ও ছাদের গায়ে অজস্র আঙুলের ছাপ আবিষ্কার করে। ক্রমে পরিষ্কার হয়ে যায়, হাজার হাজার বছর আগে এখানে আঙুলের স্পর্শ লেগেছিল। সেই থেকে দাগগুলি রয়ে গিয়েছে। পৃথিবী চক্করের পর চক্কর কেটে আরও বুড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আদিম মানুষদের চিহ্ন এখনও বহন করছে ওই গুহাগাত্র।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গুহার গভীর ভেতরের দেয়ালগুলি নরম হয়ে উঠেছে। কারণ ভূগর্ভস্থ জল চুনাপাথরে প্রবেশ করে। তারপর ধীরে ধীরে তার জলজ স্পর্শে বদলে গিয়েছে গুহা তথা সুড়ঙ্গটি। দেওয়ালগুলো নরম স্পঞ্জের মতো হয়ে ওঠে। ক্রমে সেই আর্দ্র দেওয়ালে জন্ম নিয়েছে ব্যাকটেরিয়া। আর সেই আদ্যপ্রাণীদের প্রভাবে আলোকিত মাইক্রোক্রিস্টাল তৈরি হয়। যার ফলে আলোর সংস্পর্শে এলেই গুহার দেওয়াল এবং ছাদ ঝলমলিয়ে ওঠে। এখন দেখানে গেলেই দেখা মিলবে আঙুলে আঙুলে পেঁচানো দাগের অভূতপূর্ব জলছবি!
তবে ওই দাগ ঘিরে রহস্যও কম জন্মায়নি। কেননা গুহার গভীরে যে অংশে ওই আঙুলস্পর্শ মিলেছে, সেখানে ঘন অন্ধকার। অতীতেও তা একই রকম ছিল নিশ্চিত ভাবেই। সূর্যের আলো না পৌঁছনো ওই আঁধার প্রদেশে কেমন করে তবে পৌঁছেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। মনে করা হচ্ছে, নিশ্চিত ভাবেই মশাল সঙ্গে ছিল তাদের। কিংবা শিলার সঙ্গে শিলা ঠুকে তারা তৈরি করে নিয়েছিল আগুন।
এখনও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন ঠিক কত বছর আগে ওই আঙুলের দাগ জন্ম নিয়েছিল। মোটামুটি ১৮০০ থেকে ৮৪০০ বছরের মধ্যেকার এক বিরাট সময়কালকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৪২০ থেকে ৯০টি প্রজন্মের মধ্যে কোনও এক প্রজন্মের প্রতিনিধিরা ওই গুহার অন্ধকার গভীরে রেখে গিয়েছেন তাঁদের উপস্থিতির জলছাপ। যাকে সময়ও হারাতে পারেনি। নশ্বর মানুষকে অবিনশ্বরতার গভীরে গেঁথে রেখেছে অস্ট্রেলিয়ার ওই গুহা।
গবেষকরা বলছেন, আদিম মানুষরা তাঁদের আঙুল গুহার দেওয়ালে কেবল স্পর্শ করেনি। আঙুল টেনে নিয়ে গিয়েছিল সামনের দিকে। তারা আগুন জ্বালিয়েছিল এটা মনে করা হলেও পরিষ্কার প্রমাণ কিছু মেলেনি। তবে কয়লার টুকরো বা ছাইয়ের চিহ্ন আজও আছে। কিন্তু ওখানে গিয়েছিল কেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা? সাধারণ মানুষের বসবাসের যোগ্য ছিল না ওই গুহা। খাদ্য বা আদিম যুগের যন্ত্রপাতি- কিছুরই সন্ধান মেলেনি সেখানে। তাহলে? গবেষকরা বলছেন ওখানে আসলে গিয়েছিল মুল্লা-মুল্লুংরা! কারা এই মুল্লা-মুল্লুং? এরা ওই অঞ্চলের ডাক্তার বলা চলে। সেযুগে হাসপাতাল-নার্সংহোমের স্বপ্নও কেউ দেখেনি। একদল ওষধি-জ্ঞানী নরনারীই মানুষের চিকিৎসা করত। সেই গুণী মানুষরাই ওই গুহার ভিতরে প্রবেশ করত বলে মনে করা হচ্ছে। মোল্লা-মুল্লুংরা তাদের অনুশীলনের অংশ হিসেবে স্ফটিক ও গুঁড়ো খনিজ ব্যবহার করত। আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রোগজীর্ণের আরোগ্যের পথ প্রশস্ত করত। আবার অভিশাপও দিত শত্রুদের।
সুতরাং ওই আঙুল-স্পর্শ নেহাতই আনমনে এঁকে রাখা নকশা নয়। মনে করা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃত ভাবেই ওই ভাবে দাগ টানা হয়েছিল। এবং ওই গুহার সংকীর্ণ পথে একসঙ্গে বেশি মানুষের প্রবেশও সম্ভব নয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট দল বা মতাবলম্বীরাই সেখানে নিজেদের ধর্মীয় অনুশীলন করতে যেত বলেই মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণত গুহার গায়ে যে ‘রক আর্ট’ দেখা যায় এটা মোটেই সেরকম নয়। সুতরাং ওই দাগে কেবল আমাদের পূর্বপুরুষদের পার্থিব অস্তিত্বের চিহ্নই নেই। সেকালের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের জলছাপও নিহিত রয়েছে। হাজার হাজার বছর আগেকার মানুষের স্মৃতিলব্ধ জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে সেখানে একাকার। অমৃতের পুত্রকন্যা আমরা। কোথা থেকে এসে কোথায় ভেসে যা! কেবল থেকে যায় এই সব চিহ্ন। যেমন রেখে গিয়েছে কবেকার ওই আদিম মানুষেরা। আজও যার দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের। অন্ধকার গিরিপথে তারা হেঁটে আসছে। আগুন জ্বালছে। কিংবা হাতে আগে থেকেই ধরা আছে মশাল। তারা স্পর্শ করছে গুহার শরীর। লিখে রাখছে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য আশ্চর্য ‘নকশা-চিঠি’!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.