বিশ্বদীপ দে: ৬৬ হাজার ৫৫। এবং ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ৩৪৬। দু’টি সংখ্যা। প্রথমটি ইজরায়েলি হানায় গাজায় এযাবৎ মৃতের সংখ্যা। দ্বিতীয়টি আহতের পরিসংখ্যান। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর। বছরদুয়েক ধরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার করুণ ছবির একটা বড় অংশ হলেও সেটাই সব নয়। এর সঙ্গে রয়েছে ঘরহারা, বুভুক্ষু মানুষের মিছিল, ত্রাণ আনতে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরা… অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন ৪ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ। দুর্ভিক্ষ কবলিত গাজা কি কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? ট্রাম্পের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল তেল আভিভ। এমনকী, হামাসও আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি। কিন্তু এর মধ্যেই খবর ফের ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর আক্রমণে বোমাবর্ষণ হয়েছে গাজায়। প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী হতে চলেছে গাজায়? প্যালেস্তিনীয়দের ভবিষ্যৎই বা কী?
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হওয়া হামলার বদলা নিতে প্যালেস্টাইনের জঙ্গি সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন নেতানিয়াহু। সেই শুরু। তারপর থেকেই চলছে লাগাতার সংঘাত। সংঘর্ষবিরতি নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়নি। কিন্তু সেসবের মাঝেই লাগাতার হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। যুদ্ধ থামাতে উঠে পড়ে লেগেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছেন তা বলা যাচ্ছে না। যদিও গত সপ্তাহে গাজার যুদ্ধ থামাতে ২০ দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইজরায়েল তাতে রাজি হয়ে গিয়েছে। এদিকে হামাসও টালবাহানার পর জানিয়েছে তারাও শান্তি প্রস্তাবে রাজি। সমস্ত ইজারায়েলি পণবন্দি এবং মৃত পণবন্দিদের দেহ ফেরাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। ফলে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতশেষে গাজায় যুদ্ধের সমাপ্তি এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু আচমকাই ফের ইজরায়েলি সেনার হামলায় দেখা দিচ্ছে অশনি সংকেত। আদৌ কি শান্তি ফিরবে গাজায়? প্যালেস্তিনীয়দের ছাড়তেই হবে ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’!
লাগাতার হামলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর করুণ ও তোবড়ানো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাজা। গত জানুয়ারিতে মার্কিন মসনদে ফেরার পরই ট্রাম্প মুখ খোলেন গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে। বলেন, তিনি গাজা খালি করে দিতে চান। গাজার অসহায় বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে প্রতিবেশী দেশ মিশর, জর্ডনকে অনুরোধ জানাতে দেখা যায় তাঁকে। পরে তিনি বলে বসেন, গাজা কিনতে হবে না, এমনিই নিয়ে নেবে আমেরিকা। ওখানে তো কেনার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখানেই শেষ নয়। ফেব্রুয়ারির শেষে একটি ভিডিও শেয়ার করেন ট্রাম্প। এআইয়ের সাহায্যে ভবিষ্যতের গাজার ছবি দেখিয়েছিল সেই ভিডিও। আশ্চর্য করে দেওয়া সেই ভিডিওয় দেখা যায় শিশুদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখা হামাস জঙ্গিদের। সকলে পালাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি, মানুষের স্বপ্ন। আর তারপরই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে মায়ানগর। হাওয়ায় উড়ছে টাকা। রেস্তরাঁয় জমজমাট উল্লাস। আনন্দে মশগুল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও। কারও বা হাতে ট্রাম্পের সোনালি মুখের বেলুন। পথের মাঝে ‘পৃথিবীর রাজা’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের বড় সোনার মূর্তি! এক বিলাসবহুল বাড়ির সামনে লেখা ‘ট্রাম্প গাজা’। সমুদ্রের ধারে সাঁতারের পোশাকে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। সেই অশ্লীল মজার গাজায় কিন্তু দেখা যায়নি যুদ্ধে বিপন্ন শিশুর সারি। ট্রাম্প তাদের কোথাও না কোথাও শরণার্থী সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েই যেন খালাস!
কিন্তু গত কয়েকমাসে পরিস্থিতি আরও বদলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের কি মন বদলাল? তাঁর সম্প্রতি পেশ করা প্রস্তাবগুচ্ছ সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ‘টাইমস অফ ইজরায়েল’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ট্রাম্পের সমস্ত পরিকল্পনার কথাই বিস্তারে বলা হয়েছে।
এর মধ্যে ১২ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘কাউকে গাজা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে না। তবে যাঁরা চলে যেতে চান তাঁদের ফিরে আসার সুযোগ থাকবে। সব মিলিয়ে গাজার বাসিন্দাদের সেখানেই থাকতে উৎসাহিত করা হবে। এবং সেখানেই এক উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হবে।’ অর্থাৎ ট্রাম্পের আগের বক্তব্যের থেকে অনেকটাই আলাদা কথা বলা হয়েছে।
যদিও এখনই ধরে নেওয়া যায় না, সত্যিই গাজার অধিবাসীদের সেখান থেকে তাড়ানোর কোনও রকম নতুন ছক ফের উদ্ভূত হবে না। তবু, আপাতত যেটুকু শান্তি প্রস্তাব, সেখান থেকে একপ্রকার ধরে নেওয়া যায় এটাই শেষপর্যন্ত করা হল। কিন্তু হামাস? তাদের কী হবে? তারা গাজা ভূখণ্ডে থেকে যাওয়া মানেই পরিস্থিতি যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাওয়া। ট্রাম্পের প্রস্তাবে অবশ্য বলা হয়েছে, গাজার নতুন দিনে হামাসের কোনওরকম ভূমিকাই থাকবে না। যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি হবে তাদের অবশ্য সেখানে থাকতে দেওয়া হবে। আবার যারা গাজা ছেড়ে চলে যেতে চাইবে তাদের নিরাপদে অন্য দেশে পৌঁছনোর ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু হামাস কি আদৌ গাজা ছাড়বে? অন্তত যারা থেকে যাবে তারা কি সত্যিই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি হবে!
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় শান্তি ফেরাতে বসানো হবে এক অস্থায়ী সরকার। তাতে মার্কিনরা ছাড়াও আরব ও ইউরোপীয় দেশগুলির প্রতিনিধিরা থাকবেন। ‘গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথোরিটি’ তথা GITA- প্রথম বছরের বাজেট ৯০ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী দু’বছরে তা যথাক্রমে লাফিয়ে বেড়ে ১৩৩.৫ ও ১৬৪ মিলিয়ন ডলার হবে। গাজার পুনর্নির্মাণ ও ত্রাণের জন্য বরাদ্দরৃত অর্থের পরিমাণ কিন্তু এতে যোগ করা হয়নি।
তবে মাথায় রাখতে হবে ফের কবে প্যালেস্তিনীয়দের হাতে গাজার শাসনভার ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার কোনও টাইমলাইন কিন্তু বেঁধে দেওয়া হয়নি। ইজরায়েল স্বাভাবিক ভাবেই তাদের গুরুত্বহীন করে রাখতেই চাইবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বের হস্তক্ষেপে সেটা বাস্তব না হোক, এটুকুই কাম্য গাজার সাধারণ মানুষের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.