Advertisement
Advertisement
Test Cricket

টেস্টের দিন ছেঁটে গতি আনার চেষ্টা! ক্রিকেট, তুমি পথ হারাইয়াছ?

সোনার ডিম পাড়া হাঁসটার জীবন এতে বিপন্ন হবে কি?

A write up on rumors of Test cricket being reduced from five to four days

পন্থের মতো আশ্চর্য শট খেলে গ্যালারি মাতানো ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়ছে

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:June 20, 2025 3:54 am
  • Updated:June 20, 2025 2:08 pm  

বিশ্বদীপ দে: পুরনো পৃথিবীটা যেন ক্রমেই আরও পুরনো হয়ে যাচ্ছে! গত একদশকে প্রযুক্তি এমন খেল দেখিয়েছে মানুষের মনঃসংযোগের সময়সীমাতেও নাকি কোপ পড়েছে। নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেও তা ছিল ১২ সেকেন্ড। এখন সেটাই কমে ৮ সেকেন্ডে দাঁড়িয়েছে! এমন দাবি ঘিরে তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু এটা নিয়ে নিশ্চয়ই তর্ক নেই যে এই ইনস্ট্যান্ট নুডলসের যুগে গানের দৈর্ঘ্যও ছাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন সুরকাররা। এমনকী গানের শুরুতে যে সঙ্গীত থাকে, যাকে ‘প্রিলিউড’ বলা হয়, সেটাও বাতিল করতেই বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। নাহলে লোকে নাকি স্কিপ করে যাচ্ছে সেই অংশটা! যাই হোক, এই হ্রস্বীকরণের তালিকায় সম্প্রতি ঢুকে পড়েছে টেস্ট ক্রিকেটও!

বিশ্বক্রিকেটে গুঞ্জন- টেস্টের দৈর্ঘ্য কমানোর কথা ভাবছে আইসিসি। পাঁচ নয়, চারদিনেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে একটি ম্যাচের আয়ু। বছরদুয়েকের মধ্যেই এই নতুন নিয়ম কার্যকর হতে পারে বলেই ইঙ্গিত। তবে এও বলা হচ্ছে, আপাতত ভার‍ত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াকে পাঁচদিনের টেস্ট খেলার অনুমতি দেওয়া হবে। বাকিরা খেলবে চারদিনের টেস্ট! শেষপর্যন্ত এই নিয়ম কার্যকর হবেই সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এমন এক প্রস্তাব যে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার আলোচনার টেবিলে উঠে পড়েছে, সেটাই তো প্রশ্ন তুলে দেয়, ক্রিকেট, তুমি পথ হারাইয়াছ?

timeless-test-pic
বল পড়ে ব্যাট নড়ে। ক্রিকেটের আদি যুগ

টাইমলেস টেস্ট

অথচ একটা সময় এমন টেস্ট ম্যাচও খেলা হয়েছে, যার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমাই নেই। সোজা কথায় যাকে বলা হত ‘টাইমলেস টেস্ট’। নাম থেকেই পরিষ্কার, ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত খেলে যেতে হবে। কোনও নেহাত পরীক্ষামূলক প্রয়োগ নয়। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়বিহীন টেস্ট খেলা হয়েছে ৯৯টি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া সব টেস্টই ছিল টাইমলেস! তবে মাত্র দু’টি ম্যাচই ড্র হয়েছিল।

তবে টাইমলেস টেস্ট বলতে যে ম্যাচটির কথাই ক্রিকেটরসিকদের মাথায় আসে সেটি খেলা হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। ইতিহাসে এই ম্যাচের গুরুত্ব দু’টি কারণে। এটাই শেষ টাইমলেস টেস্ট। আর ১২ দিনের পরও সেই ম্যাচ শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত ভাবে! তবে দু’দিনের বিরতি ছিল। ব্যাট-বলের লড়াই হয়েছিল মোট ১০ দিন বা ৪৬ ঘণ্টা। যা ইতিহাসের দীর্ঘতম প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। ততদিনে পৃথিবীর মাথার উপরে ঘনাতে শুরু করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া। যে কোনও সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আর বাড়ি ফেরা হবে না! এই আতঙ্কে ইতিহাসের দীর্ঘতম ক্রিকেট ম্যাচকে অমীমাংসিত রেখে দিয়েই মাঠ ছাড়ে ইংল্যান্ড।

একটা ম্যাচ। টানা দশ দিন ধরে চলছে খেলা! ভাবা যায়! বল পড়ছে, ব্যাট ঘুরছে… যেন এক অনন্ত প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর জীবনঘূর্ণি যত গতি পেয়েছে তত বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে টাইমলেস টেস্ট। ক্রিকেটরসিকরা গালে হাত দিয়ে বসে ভেবেছে, কী করে অতদিন ধরে খেলার মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন ক্রিকেটাররা!

ওয়ানডের জন্ম

কিন্তু সেই হারানো সময়ের গল্পগাছা করে লাভ নেই। গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় দেখা যায়, ক্রিকেট মাঠে লোক-টোক বিশেষ হচ্ছে না। লাগাতার ড্র আর ড্র দেখে দর্শকরা ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এক একটা রান করতে বিস্তর সময় নিচ্ছিলেন ব্যাটসম্যানরা। কাউন্টি ক্রিকেট দেখতে মানুষ আর আগ্রহই অনুভব করছিলেন না। বলা হত, কুকুর আর পাদরি (পাদরিদের ক্রিকেট প্রীতির কথা সর্বজনবিদিত, কিংবদন্তি ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্ডাসের লেখাতেও যার উল্লেখ রয়েছে) ছাড়া আর কেউ মাঠে আসে না খেলা দেখতে! এমনই এক পরিস্থিতিতে জন্ম হয়েছিল সীমিত ওভারের ক্রিকেটের।

Smriti Mandhana reclaims No. 1 ranking in ICC Women’s ODI
সীমিত ওভারের ক্রিকেট মানেই উত্তেজনা

এখানে উপমহাদেশের একটা ভূমিকাও কিন্তু রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সাহেবদের এই খেলা এখানেও জাঁকিয়ে বসতে থাকে। ক্রিকেটের চরিত্র বদলে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটাও হয়তো একটা ফ্যাক্টর। অনেকে হয়তো বলবেন, ইংল্যান্ডেই তো খেলা হয়েছিল জিলেট কাপ। যার সাফল্য ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনালের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু অস্বীকার করা যায় কি কেরলের অল ইন্ডিয়া পূজা ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে? সেটা ১৯৫১ সালে। কোচিনের ত্রিপ্পুনিতুরায় নবরাত্রির সময় আয়োজিত হয়েছিল ওই প্রতিযোগিতা। প্রাক্তন ক্রিকেটার কে ভি কেলাপ্পান থাম্পুরানের মাথায় আইডিয়া আসে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করার। মারকাটারি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ওই প্রতিযোগিতা এই ইতিহাসকেও কিন্তু ভুললে চলবে না।

যাই হোক, ১৯৭০-৭১ সালের অ্যাসেজের মাঝামাঝি আচমকাই জন্ম নেয় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে যাওয়া ম্যাচের আর্থিক ক্ষতি সামলাতে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানই প্রস্তাব দেন একটি একদিনের ম্যাচের আয়োজন করার জন্য। ডনের প্রস্তাব ছিল সীমিত ওভারের খেলা হলে আর্থিক ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে ওঠা যাবে। তাঁর আইডিয়া ছিল নির্ভুল। ৪৬ হাজার দর্শক এসেছিলেন মাঠে। এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের রোজগার হয়েছিল ৩০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারেরও বেশি। সোনার ডিম পাড়া একটি হৃষ্টপুষ্ট হাঁসের অবয়ব কিন্তু ফুটে ওঠে এই সময় থেকেই। তারপর ক্রমে ওয়ানডে জনপ্রিয়তার নতুন নতুন মাইলফলক ছুঁতে থাকে। তিরাশিতে ভারত আর বিরানব্বইয়ে পাকিস্তানের বিশ্বজয় খেলাটাকে এখানেও তুমুল জনপ্রিয় করে তুলল।

Ned vs Nep: For the first time 3 super overs are played in one match

গতিই শেষ কথা!
পঞ্চাশ ওভারের পর কবে টিটোয়েন্টির জন্ম হল তা আমাদের সকলেরই জানা। কোনও সন্দেহ নেই, ২০০৭ সালের ধোনির নেতৃত্বে ভারতের ওই ফরম্যাটে বিশ্বজয় এবং অব্যবহিত পরে ললিত মোদি নাম্নী এক ‘জাদুকর’-এর ক্রিকেট ও বিনোদনকে এক ফ্রেমে বন্দি করে ফেলায় গ্ল্যামারের বিচ্ছুরণে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, চার-ছয় মারাটাই বোধহয় ক্রিকেট। বোলার বেচারিদের কাজ স্রেফ সেই বিনোদনের রসদ জোগানো।

অনেকে তর্ক করে বলতেই পারে, এই চ্যালেঞ্জ সামলে অনেক বোলারও ম্যাচ উইনারও হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ব্যাটারকে রোখা, উইকেট তোলা যেন সেখানে সেকেন্ডারি! তবে এও সত্যি টেস্ট ক্রিকেটের ধমনীতে কিন্তু তাজা রক্ত ঢুকিয়েছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটই। ফিটনেস থেকে ঝকঝকে গতির এক উড়ান টেস্টকেও করে তুলেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচও সাড়ে তিনদিনের কমেই শেষ হয়েছে। এদিকে খেলা পাঁচদিনে গড়ালে ভিউয়ারশিপ সমস্যায় পড়ছে। আধুনিক ক্রিকেটে, কেবল ক্রিকেটই কেন, সামগ্রিক খেলার দুনিয়াতেই ‘ব্রডকাস্টিং রেভিনিউ’ একটা অনস্বীকার্য ব্যাপার। কাজেই…

এই দৃশ্য কি আর দেখা যাবে?

‘কিছু মায়া রয়ে গেল দিনান্তের’
নিখুঁত আলাপের পর ধীরে ধীরে বিস্তার বা জোরে প্রবেশ করলে তারপরই এক সময়ে ঝালায় পৌঁছনো যায়। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এই ‘আলাপ-জোর-ঝালা’ ত্রহ্যস্পর্শকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনই ক্রিকেট মানেই কেবল উত্তেজনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছনো মুহূর্তের সমষ্টি মাত্র নয়। মারার মতো বল ছাড়াও এক নিপুণ শিল্প। বল পড়ে ব্যাট নড়ে। খেলা এগোয়। একেকটি রানের জন্য আকুতি, হারা ম্যাচ ড্র করার সংগ্রাম- এও কী মানুষের চোখের সামনে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ফুটিয়ে তুলে ধরে না? জীবনের আশ্চর্য সব শিক্ষার ‘সিলেবাস’ এভাবে ছড়ানো বলেই তো ক্রিকেট এত জনপ্রিয়।

কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ততই চালিয়ে খেলাকে গ্ল্যামারাইস করা হয়েছে। হয়তো ব্যবসা এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে বলেই। ‘জেন্টলম্যান’ ও ‘প্রফেশনাল’দের দ্বিধাবিভক্তিকে আমরা বহু দূরে ফেলে এসেছি। মিঠে রোদ্দুর, লাল বল, বলে ছ’টা সেলাই, উলের কাঁটায় ঘর পড়া-ঘর তোলা সময়ের ধীর লয়ের সঙ্গে মিলেমিশে খেলা এগিয়ে যাওয়ার সেই দিন আর ফিরবে না। খেলাটাকে ‘স্মার্ট’ করতে গোলাপি বলে দিন-রাতের মোড়কে মুড়ে ফেলাটা তাও মানা যায়। কিন্তু রক্ষণ-আক্রমণের সমতাকে অস্বীকার করে খেলাটার এতটা চরিত্র বদল কি আদৌ দরকার ছিল? সময়োপযোগী করা আর চরিত্র হনন এক জিনিস নয়। পাঁচদিন থেকে চারদিনে খেলা সম্পন্ন করাটা সেই প্রয়াসেরই নতুন অধ্যায় হতে যাচ্ছে।

ব্র্যাডম্যানের প্রস্তাব মেনে আয়োজিত প্রথম সরকারি ওয়ানডে যে হাঁসের জন্ম দিয়েছিল সে এতদিন ঠিকই ডিম জুগিয়েছে। কিন্তু খেলাটার হ্রস্বীকরণের এমন মরিয়া প্রয়াস কি আখেরে হাঁসটাকেই বিপণ্ণ করে তুলছে না? টিকিট বা ডেটা প্যাকের খরচ কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিয়ে আজকের ক্রিকেটের আমোদে বুঁদ হচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাই একদিন বলবেন না তো, ”কেবলই মার, মার! তোমার রক্ষণ নাই ক্রিকেট?” সেদিন তাঁরা যদি চার-ছয়ের ‘একঘেয়েমিতে’ মাঠ ছাড়েন অন্য খেলায় মাতবেন বলে… তখন? জীবনে সব কিছুকে কিন্তু ‘কন্ট্রোল+জেড’ করা যায় না।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement