পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন থেকে অস্ট্রিয়া এবং ব্রাজিলের মতো ব্রিটেনও ভোটাধিকারের বয়স হবে ১৬ হিসাবে মঞ্জুর করেছে। ভবিষ্যতে ভারতও কি এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে? ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা জীবনের পথে বড় হওয়ার বড় চিহ্ন। ‘নাবালক’ দশা ঘুচে গেলে, তার প্রভাব কিন্তু আইনি বিচারেও পড়বে। ১৬ আসুক নেমে। লিখছেন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়।
‘প্রাপ্তেষু ষোড়শ বর্ষে পুত্র মিত্র বদাচরেৎ’। অর্থাৎ, ছেলের ১৬ বছর বয়স হলে পিতা তার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে। এমন কথা নাকি শাস্ত্রেই বলা হয়েছে। হাজার-হাজার বছর আগে ভারতীয় শাস্ত্ররচয়িতারা মনে করেছিলেন, নাবালকত্বের স্তর পেরিয়ে ১৬ বছর বয়সি পুত্র সাংসারিক বা বৈষয়িক বিষয়ে স্বাধীন মতামত দেওয়া বা চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ হওয়ার ধাপে পা দেয়। যদিও এর নেপথ্যে কোনও বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা সেসময় সম্ভব ছিল না।
বিস্তর ভাবনাচিন্তার পর আধুনিক বিশ্বে ১৮ বছরকে সাবালকত্বে পৌঁছনোর সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা তাদের কিছু বাড়তি আইনি অধিকারের সুবিধা দিয়েছে। তবে উল্টোদিকে রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতাও। কিন্তু কেন ১৮ বছরকেই ‘মাপকাঠি’ ধরা হবে? তার কমে নয় কেন?
নাবালকের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বিশেষত, গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে। দিল্লির নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ড সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই নৃশংস ঘটনার অন্যতম একজন আসামির বয়স ১৮ বছরের কয়েক মাস কম হওয়ায় আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী তাকে ‘নাবালক’ বলে গণ্য ক’রে তার বিচার হয় জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে। বিচারে তার শাস্তি হয় মাত্র তিন বছরের জেল। বিচারপর্ব চলাকালীন প্রায় আটমাস সে জেলে কাটিয়েছে। অর্থাৎ, অবশিষ্ট দু’-বছর চার মাস সংশোধনাগারে কাটিয়ে সে মুক্তি পেয়েছে। এত বড় একটা অপরাধ করেও তার কোনও বড় শাস্তি হল না। তাই একে ‘সুবিচার’ বলে মনে করেনি নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ।
গত বছর মদ্যপ অবস্থায় পুণেতে পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দুই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে পিষে দিয়েছিল ধনকুবের ব্যবসায়ীর ছেলে। বয়স ১৮-র কম হওয়ায় ‘নাবালক’ রূপেই তার বিচার হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড।
‘নাবালক’-এর সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করা দরকার কি না, এই প্রশ্নে নতুন করে মতভেদ দেখা দিয়েছে। কোনও কোনও মহলের অভিমত, নাবালকত্বের বয়ঃসীমা ১৮ বছর থেকে কমানো উচিত। বিচারপতি জে. এস. ভার্মা কমিটি নারী নিগ্রহ রোধে সংশ্লিষ্ট আইনে বড়সড় বদলের সুপারিশ করলেও নাবালকত্বের সীমা ১৮ থেকে কমানোর কথা বলেনি। যদিও দিল্লি কাণ্ডে গণধর্ষিতা, মৃতার পরিবার দাবি তুলেছিল, অপরাধের চরিত্র দেখেই সাজা দেওয়া উচিত, অপরাধী ‘নাবালক’ না ‘সাবালক’, সেটা বিচার্য হওয়া উচিত নয়। সরকারও বলেছিল, ফৌজদারি মামলায় অপরাধের গুরুত্ব বিচারের মাপকাঠি এবং নাবালকত্বের বয়সের সীমা নতুন করে বেঁধে দেওয়া নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবনাচিন্তা, আলোচনা করার দরকার আছে।
সরকার এ নিয়ে বিতর্কের জন্য তৈরি। কিন্তু তারপরেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা এগয়নি। যদিও বিভিন্ন রাজ্যের জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্যরা জানিয়েছেন, নির্ভয়া কাণ্ডের আরও তিন বছর পর, ২০১৫ সালের পর জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টে যে-বদল এসেছে তাতে অপরাধের গুরুত্বের উপর নির্ভর করে ১৬-১৮ বছরের নাবালকদের সাবালকদের মতো দেখা হয়। বিচারও সেভাবেই হয়। নাবালকদের ক্ষেত্রে প্রতিটা মামলা আলাদা আলাদা করে বিচার করা হয় বিভিন্ন প্রেক্ষিতের কথা মাথায় রেখে। বিষয়টার সঙ্গে তার মনস্তত্ত্ব জড়িয়ে আছে, রয়েছে সাইকো-সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড, পারিবারিক অবস্থা এবং সর্বোপরি যে-অপরাধ সে করেছে তার পরিণতি সম্পর্কে জানত কি না– এমন অনেক বিষয় সম্পর্কিত, সংশ্লিষ্ট।
কিন্তু ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নাবালকদের বিরুদ্ধে ৩১,১৭০টি অপরাধের মামলা দায়ের করা হয়েছিল ভারতে। ২০২০ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল ২৯,৭৬৮। অভিযুক্তদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু ১৬-১৮ বছরের মধ্যে। গত কয়েক বছরে একাধিক ঘটনা উঠে এসেছে যেখানে ধর্ষণ বা সহিংস অপরাধে অভিযুক্তরা নাবালক। অল্পবয়সিদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও ক্রমশ বাড়ছে। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, সুলভে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সংযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণের অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়– কারণ নানাবিধ। ইন্টারনেটের কল্যাণে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা এখন অনেক পরিণত। তাই টিনএজের আগে পর্যন্ত একটি ধাপ, তারপরে ১৩ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত আর-একটি ধাপ করা যেতেই পারে। যা অপরাধের গুরুত্ব ও তাদের শাস্তি নির্ধারণে সহায়ক হবে। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনও আনা যেতে পারে।
হঠাৎ করে কেন নাবালকত্বের সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ল? এক) নির্ভয়া কাণ্ডের পর এক যুগ কেটে গেলেও অপরাধচিত্র, বিশেষত, নারীনিগ্রহের ক্ষেত্রে তেমন কোনও বদল চোখে পড়েনি। নাবালক বহু অপরাধী নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েও আইনের ফঁাক গলে পার পেয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে পরবর্তী শিকারের জন্য। সামাজিক ক্ষেত্রে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে।
দুই) প্রায় ছ’-দশক আগে ১৯৬৯ সালে ব্রিটেনে ভোটাধিকারের বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৮ করা হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে সংবিধানের ৬১তম সংশোধনী এনে সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেছিল ভারতও। ব্রিটেন ঘোষণা করেছে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন থেকে ব্রিটেনে ভোটাধিকারের বয়স হবে ১৬ বছর। এ-বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের যুক্তি, ‘আইনে তরুণ নাগরিকদের ১৬ বছর বয়সে চাকরি করার অনুমতি রয়েছে। তাদের বাইরে কাজ করার জন্য যথেষ্ট বয়স হয়েছে, তাদের কর দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বয়স হয়েছে।
সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, কেউ যদি কর দেয়, তাহলে তার অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে বিষয়ে মত দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।’ অস্ট্রিয়া এবং ব্রাজিলেও ১৬ বছর বয়সে ভোট দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। ভবিষ্যতে ভারত যে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। তাহলে যে-ছেলে বা মেয়েটি ১৬ বছরে যুক্তি-বিবেচনা কাজে লাগিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, সে শুধু অপরাধের ক্ষেত্রে আইনি সুবিধা পাবে ‘নাবালক’ হিসাবে, এটা বোধহয় চরম প্রবঞ্চনা।
বিভিন্ন কারণে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর ‘আঠারো বছর বয়স’-এর সেই ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা, দুঃসাহস, পদাঘাতে পাথর বাধা ভাঙার স্বপ্ন, রক্তদানের পুণ্য অর্জনের লক্ষ্য এখনও যেমন রয়েছে– তেমনই নেতিবাচক কারণে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসার ঘটনাও কম নেই। আর সেক্ষেত্রে ১৮ বছর তো দূর, বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় উপনীত হয়েই অপরাধে হাতেখড়ি, দুষ্কর্মে যুক্ত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে অজস্র। আইন তো স্থবির কিছু নয়। সময়, পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাঝে মধ্যেই তার পরিমার্জন, সংশোধন জরুরি। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ধূমপান করবে, পানশালায় ভিড় করবে, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারবে, ধর্ষণ করবে আর আইনের দোহাই দিয়ে মুক্তি পাবে, এই অবস্থার বদল হওয়া দরকার। সার্বিকভাবে যদি নাবালকত্বের সংজ্ঞায় বদল না-ও হয়, তবুও প্রতিটি নাবালক অপরাধীর প্রেক্ষিত বিচার করে কঠোর সাজা নিশ্চিত করাও সমাজের মঙ্গলের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.