ট্রাম্প সমালোচিত হচ্ছেন বিদেশের লড়াইয়ে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ইরাক যুদ্ধের জন্য একদা জর্জ ডব্লিউ বুশকে দায়ী করে যিনি বলেছিলেন, বুশ শুধু দেশের অর্থ অপচয় করেননি, নাগরিকদের জীবনও বিপন্ন করে তুলেছেন, সেই তিনিই ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে বিরুদ্ধাচারণ করলেন। লিখছেন সৌম্যা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধের কৃতিত্ব তঁার পাগড়ির প্রথম ঝলমলে পালক হলে, দ্বিতীয় পালকটি অবশ্যই পশ্চিম এশিয়ায় আচমকা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। মঙ্গলবার কাকভোরে অননুকরণীয় স্টাইলে ইজরায়েল-ইরান ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এই বার্তাই দিতে চাইলেন যে, এখনকার দুনিয়ায় তিনিই বিধাতা। তাঁর ইচ্ছাই সব। তিনিই নিয়ন্ত্রক।
এর ফলে ১২ দিনের ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধের যবনিকা পতন ঘটতে চলেছে কি না, ঘটলেও তার চরিত্র কেমন, আগামী কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ তা বুঝিয়ে দেবে। মঙ্গলবার সকালে ট্রাম্পের ঘোষণার জবাবে ইরান জানায়, যুদ্ধ তারা শুরু করেনি। করেছে ইজরায়েল। আক্রান্ত হলে পাল্টা জবাব তারা দেবেই। না হলে দেবে না। এই বার্তা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত নমনীয়তারই পরিচয়। আমেরিকা ও ইজরায়েলের জোড়া আক্রমণ সামাল দিলেও হঁাপ ফেলার জন্য তাদের সময় দরকার। সেই বিবেচনায় ইরানের এই সিদ্ধান্ত যথার্থ। এতে সাময়িকভাবে পশ্চিম এশিয়ার উত্তেজনা প্রশমিত হবে, যদিও ভবিষ্যতের জন্য অনেক প্রশ্ন রেখে যাবে (যদিও অপেক্ষার প্রহর না বাড়িয়েই মঙ্গলবার, ভারতীয় সময় বিকেলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দেন, ইজরায়েল ও ইরান দু’পক্ষই যুদ্ধবিরতি নীতি উল্লঙ্ঘন করেছে)।
ইরানের পরমাণু স্থাপনা ‘ধ্বংস’-র সদর্প দাবি জানানোর পর এত দ্রুত যুদ্ধবিরতির পথে ট্রাম্প কেন হঁাটলেন? প্রশ্নটির ব্যাখ্যা একাধিক। প্রথমত, ট্রাম্প হয়তো ভেবেছেন, বি২ বম্বারের বাঙ্কার বাস্টার বোমাবাজি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিকেশ করেছে। ফলে সমঝোতার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু আগ্রাসন যে কাঙ্ক্ষিত ফল দেয়নি, হয়তো সেই উপলব্ধিও তঁার হয়েছে। বিশেষ করে বিজ্ঞজনরা যখন অনেকেই বোমাবাজির কার্যকরিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এ-ও বলাবলি হচ্ছে, ইরান বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম আগেভাগেই সরিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া, পাহাড়ের ৩০০ ফুট গভীরে সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য ফোরদো গবেষণাকেন্দ্র বোমাবর্ষণের পরেও অটুট। ইরানও জানিয়েছে, বিন্দুমাত্র তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটেনি। সবাই নিরাপদে।
এই ধারণাই দ্বিতীয় ব্যাখ্যার জন্ম দিচ্ছে। কারণ, ওই মারাত্মক বোমাবাজির পর ভয়ে কুঁকড়ে
না-গিয়ে ইরান নিজের শক্তি জাহিরই শুধু করেনি, কাতারে মার্কিন সামরিক ঘঁাটিতে অবিরাম মিসাইল ছুড়ে বুঝিয়েছে নতজানু হওয়ার বান্দা তারা নয়। প্রত্যাঘাতের আগে তারা দুটো জরুরি কাজ করেছে। কাতারকে জানিয়েছে, তারা ইরানের ‘বন্ধু’। ইরানের ‘লক্ষ্য’ তারা নয়। লক্ষ্য
সে-দেশের মার্কিন ঘঁাটি। সেই ঘঁাটিতেই তারা হামলা চালাচ্ছে প্রতিশোধ নিতে। ইরানকে তারা যেন ভুল না বোঝে। দ্বিতীয় কাজটা যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করা। ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার আগে এভাবে সতর্ক করার মধ্য দিয়ে তারা ট্রাম্পকে বোঝাতে চেয়েছে, পাল্টা মারের ক্ষমতা তাদের শেষ হয়ে যায়নি। পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার দেড় ডজনেরও বেশি সামরিক ঘঁাটি তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়। দ্বিতীয়বার আঘাতের আগে তারা আগাম জানাবে না।
আমেরিকার অভ্যন্তরে, এমনকী ট্রাম্পের নিজের দলেও, প্রতিরোধ দিন-দিন বাড়ছে। মার্কিনিদের সবচেয়ে ক্ষিপ্ত করে অবাঞ্ছিত ‘বডি ব্যাগ’। ট্রাম্প সমালোচিত হচ্ছেন বিদেশের লড়াইয়ে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ইরাক যুদ্ধের জন্য প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে দায়ী করে যিনি বলেছিলেন, বুশ শুধু দেশের অর্থ অপচয় করেননি, নাগরিকদের জীবনও বিপন্ন করে তুলেছেন, সেই ট্রাম্প ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে নিজের স্ববিরোধী চরিত্র মেলে ধরলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। ‘শান্তির দূত’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরে এসে প্রথমে তিনি গাজা ধ্বংসে মদত দিলেন, তারপর ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েলকে শুধু মারমুখী-ই করে তুললেন না, সেই যুদ্ধে নিজেকেও জড়ালেন। কোনও স্বঘোষিত ‘শান্তির দূত’ এত দ্রুত এভাবে কখনও ‘যমদূত’-এ রূপান্তরিত হননি! স্ববিরোধিতার এত বড় উদাহরণ তঁার কোনও পূর্বসূরিরও নেই। আরও জড়িয়ে পড়ার আগে তাই তিনি এমন একটা ভাব দেখাতে চাইছেন, যার অর্থ, একমাত্র জয়ীরাই মহানুভব হতে পারে। তিনি মহানুভব। শান্তির পূজারি।
তাই সন্ধির পথে হঁাটছেন।
এভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পিছনে ‘শান্তির দূত’ ট্রাম্পের মনে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার আশা কি কিঞ্চিৎ দোলা দিয়েছে? হতে পারে। কেননা, হতাশাগ্রস্ত ট্রাম্প নিজেই নিজের ঢাক পিটিয়ে আক্ষেপ ঝরিয়ে ক’দিন আগেই বলেছিলেন, ‘কঙ্গো-রোয়ান্ডা অথবা সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাত থামানো কিংবা ভারত-পাকিস্তানের মতো দুই পরমাণু অস্ত্রধর দেশের ভয়ংকর যুদ্ধ বন্ধের জন্য চার-পঁাচটা নোবেল পুরস্কার তঁার পাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু তা হওয়ার নয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু উদারপন্থীরাই পায়।’ ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যুগলবন্দি পশ্চিম এশিয়ার ভবিষ্যৎকে কীভাবে নির্ধারিত করবে, তা নিয়ে সারা বিশ্ব সোমবার রাত পর্যন্ত চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিল। সন্দেহ নেই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেনেবুঝেই বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ইরানকে ভয় দেখিয়ে মার্কিন শর্তে চুক্তি করাতে চাইছিলেন। ইরান সেই রাস্তায় না-হেঁটে জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ফল’ ভোগ করতে হবে। ট্রাম্পের উদ্দেশে তারা বলেছিল, এই যুদ্ধ আপনি শুরু করলেও শেষ করব আমরা। ওই হুঁশিয়ারির মধ্য দিয়ে পারস্য জাত্যভিমান ও অদম্য চারিত্রিক বৈশিষ্টে্যর একটা ঝলক দৃশ্যমান হয়েছিল।
কাতারে মার্কিন ঘঁাটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ ছিল সেই চরিত্রের উন্মেষ। এ আবহে ভারতের কোনও ভূমিকা ছিল না। কিছু করারও ছিল না। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানকে সংযত হওয়ার উপদেশ দেওয়া ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুই করতে পারেননি। এমন উপদেশ বা পরামর্শ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেওয়ার মতো অবস্থানও তঁার ছিল না। তবে এটা ঠিক, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সবার মতো ভারতের দুশ্চিন্তাও খানিক কাটিয়েছে।
ইজরায়েল ও ইরান দুই দেশ-ই ভারতের ‘মিত্র’। কোনও এক পক্ষকে সমর্থন বা বিরোধিতা করার উপায় তার নেই। ‘গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’-এর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ১৬২ বিলিয়ন ডলারের। প্রায় এক কোটি ভারতীয় পশ্চিম এশিয়ায় রুজিরোজগারে ব্যস্ত। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তেলের জোগান থেকে শুরু করে বাণিজ্য হ্রাস তো হতই, এত প্রবাসীকে নিরাপদে দেশে ফেরানোর দায়িত্বও ভারতকে নিতে হত। ইরানের চাবাহারে বন্দর চালাতে ভারত চুক্তিবদ্ধ। ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে অনিশ্চয়তার মেঘ চরাচর ছাইত। চৌপাট হয়ে যেত অর্থনীতি। যুযুধান দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও ট্রাম্পকে না-চটিয়ে মন জুগিয়ে চলার ছল ভারতকে করে যেতেই হত। শিয়রে ঝুলছে বাণিজ্য চুক্তি। ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক এড়ানো না-গেলে বিপর্যয়ের একশেষ। ঈশ্বরের কাছে যুদ্ধ বন্ধের প্রার্থনা ছাড়া ‘বিশ্বগুরু’ ভারতের দ্বিতীয় উপায় ছিল না।
তড়িঘড়ি যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ইরানের পাশে পুতিন ও শি জিনপিংয়ের দঁাড়ানোর ইঙ্গিত ট্রাম্প হয়তো পেয়েছিলেন। ইরানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে তাই ওই ঘোষণা। ট্রাম্পকে যারা পাগল ভাবে, তারাও স্বীকার করে– আর যাই হোক তিনি বুদ্ধিহীন নন। মার্কিন একাধিপত্য রুখতে শি-পুতিন পাল্টা যুগলবন্দি শুরু হলে পশ্চিম এশিয়ার ক্যানভাসের চিত্রপট দ্রুত বদলে যেত। সেটা হতে পারত শেষের শুরু।
এত কিছুর পরেও ইরানের হাতে ৯০০ পাউন্ড বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম অক্ষত থাকলে এতকাল যা করেনি বা করতে চায়নি, এবার হয়তো তারা দ্রুত সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইবে। এত দিন ধরে তারা বলেছিল, পরমাণু কর্মসূচির উদ্দেশ্য বোমা
বানানো নয়। আণবিক বোমা কখনও বানাবে না। যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েল যুগলবন্দির অভিজ্ঞতা তাদের সেই পথ পরিত্যাগে বাধ্য করলে ডোনাল্ড ট্রাম্প-ই দায়ী থাকবেন। ১২ দিনের যুদ্ধ ও যুদ্ধবিরতির অনিশ্চিত দিকগুলির মধ্যে এটাই প্রধান। বারাক ওবামা ও জো বাইডেন সংঘাতের পথে না-গিয়ে ইরানকে সমঝোতার বার্তা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প বোঝাতে চাইলেন, একমাত্র শক্তিধররাই শান্তি স্থাপনে সক্ষম। এই তত্ত্ব ইরান গ্রহণ না-করলে সেটাই হবে ঘোর বিস্ময়ের। কারণ, তারা বুঝেছে, আঘাত তো দূরের কথা, পরমাণু শক্তিধর হলে এত সহজে কেউ তাদের চোখও রাঙাতে পারত না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.