১ অক্টোবর থেকে সরকারি বরাদ্দের অভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধ করে দিল ‘নাসা’। শুধুমাত্র জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীরাই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আপাতত। এই অচলাবস্থা নাসার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি এবং গবেষণার উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। প্রশ্ন হল– এই পরিকল্পনাহীন ভাবনার নেপথ্যে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য কী? লিখছেন শুভময় মৈত্র।
এ মুহূর্তে একটি উদ্বেগের খবর– ‘নাসা’ (‘ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’) ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে সরকারি বরাদ্দের অভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধ করে দিল। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন দেশে বাজেট পাশ করানো নিয়ে গোলমালের নিরিখে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে পিছিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছিল। হাজার-হাজার ফেডারেল কর্মীকে নাকি ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে সম্ভবত নাসার কর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত। নাসার আকাশপাতায় প্রকাশিত শব্দবন্ধে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাদ বাকি বিভিন্ন প্রকল্প আপাতত স্থগিত। তবে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অবস্থানরত নভোচারীদের পর্যবেক্ষণ, সৌরজগৎজুড়ে চলমান মহাকাশযান, এবং গ্রহ প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন সীমিত কর্মী নিয়ে চালু রাখা হয়েছে। বুঝতে কোনও অসুবিধেই হয় না যে, এই অচলাবস্থা নাসা-র ভবিষ্যৎ কর্মসূচি এবং গবেষণার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। ঘেঁটে যাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকা গবেষণা। এখানেই আসছে ট্রাম্পের কথা।
তাঁর কাছে চার ইংরেজি অক্ষরের ‘নাসা’-র তুলনায় ‘মাগা’-র গুরুত্ব বেশি। বাংলায় ‘মাগা’ শব্দের অর্থ চাওয়া, তবে সেই চাওয়ার মধ্যে নম্রতা থাকে, থাকে তুচ্ছতা। আর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’-এর প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে যে-ইংরেজি উচ্চারণ, সেখানে আদতে রাজনৈতিক অবিবেচনার বিষয়টি বহুমাত্রিক। ট্রাম্পের মতো একজন মানুষ, যঁার রাজনৈতিক গভীরতা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রশ্ন ওঠে, তিনি যেভাবে আবার দেশের শীর্ষ পদে ফিরে এলেন, সেই বিষয়টির মধ্যেই একটা বিরাট বড় ‘এগেইন’ আছে। অর্থাৎ তঁার এই শুরুর জয়ের পর মাঝে একবার হেরে আবার ফিরে আসা– গণতন্ত্রের গরিমায় বলীয়ান হয়ে।
প্রসঙ্গত, বলতেই হয় যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে আধিপত্যবাদের বিষয়টি ইতিহাসে বহুবার প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। একবার ক্ষমতায় এসে সংসদীয় ব্যবস্থাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে একাধিকবার নির্বাচনে সফল হওয়ার উদাহরণ চারপাশে একগাদা। আমরা এই লেখায় অত্যন্ত সতর্কভাবে শুধুমাত্র দূর দেশ নিয়ে আলোচনা করব। সুতরাং সেই ভোট বিশ্লেষণে রাশিয়ার পুতিনের কথা আসবে। পুরনো ইতিহাসে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তিনি যে-জায়গায় বেশি গুলিয়ে ফেলেছিলেন, সেটা হল ১৯৩৩ সালের পর সুষ্ঠু নির্বাচন আর সেভাবে হয়নি।
এখন, পুতিন কিন্তু এমনভাবে নির্বাচন চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে বিরোধীরা জানে কিছুতেই জিততে পারবে না, তবু ভোট হয়। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এই অপবাদ দেওয়া যাবে না। পরপর তিনটি নির্বাচনেই মার্কিন দেশের সংসদীয় ব্যবস্থা নিয়ে সেভাবে কোনও প্রশ্ন নেই। মাঝেরটা তিনি হেরেছিলেন, হেরে ঝামেলা পাকিয়েছিলেন, জোর করে ক্ষমতা দখলের একটা ছোট্ট চেষ্টাও দেখা গিয়েছিল। তাই নিয়ে আইনি বিভিন্ন লড়াই। কিন্তু গণতন্ত্রের যুক্তি এমনই সরলরৈখিক যে, ট্রাম্প হেরে গেলে সেটা যদি পরিণত গণতন্ত্রের প্রমাণ হয়, তিনি জিতলে তা বদলে ফেলা যায় না। ফলে তিনিই ঠিক করবেন ‘এগেইন’ বলতে আগের কোন সময়টা। তঁার অগভীরতার যে বিষয় নিয়ে এত আলোচনা, তাতে তিনি ইতিহাসে খুব অতীতে যাবেন– এমন আশা না-করাই ভাল। সেই হিসাবে তঁার বর্তমান রাজত্বে তিনি আমেরিকাকে নিজেরই আগের শাসনের স্তরে উন্নীত করতে চাইবেন, তা বলাই বাহুল্য। কারণ তঁার নিজের মূল্যায়নে তিনিই তো মার্কিন দেশের সেরা প্রেসিডেন্ট!
এবার কোন নেতা বা নেত্রী কতটা মেগালোম্যানিয়াক, সেই নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু বিনির্মাণটাও জরুরি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে জিততে গেলে যথেষ্ট জনসমর্থন পেতে হয়। সেইখানে একটা অঙ্ক পরিষ্কার। এই মুহূর্তে বিশ্বব্যবস্থায় বেশিরভাগ দেশেই বহু মানুষ নিম্নবিত্ত। সুতরাং তাদের ভোটেই নেতা নির্ধারিত হবেন। মার্কিন দেশে সেভাবে তৃতীয় বিশ্বের মতো আর্থিক অসংগতি নেই। কিন্তু তবু সেখানকার এক বিরাট সংখ্যক মানুষ যে খুব ভাল আছে– এমন নয়। সেখানকার যে দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ, বেঁচে থাকার জন্য যে বিপুল পরিশ্রম, চুক্তিভিত্তিক কাজের অনিশ্চয়তা, চিকিৎসা পরিষেবার অপ্রতুলতা– সব মিলিয়ে ক্ষোভের জায়গা প্রচুর। যে-নেতা সেই ক্ষোভকে ব্যবহার করে মানুষের সমর্থন পাবেন, তিনিই নির্বাচনে জয়যুক্ত। অর্থাৎ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা মহাকাশ গবেষণায় অর্থবরাদ্দ কমিয়ে দিলে অথবা সরকারি কর্মচারীদের মাইনে দেরি হলে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের অখুশি হওয়ার কারণ নেই। এবার প্রশ্ন হল– ট্রাম্পের এই ভাবনাকে কি পরিকল্পনাহীনতা বলা যাবে, যাতে আগামীতে মার্কিন দেশের ক্ষতি হবে?
এর উত্তর একটি উদাহরণ সহযোগে দেওয়া যাক। মহাকাশ গবেষণার একটি অংশ অবশ্যই এখনকার দিনে কৃত্রিম উপগ্রহ। তার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দূরযোগাযোগ ব্যবস্থার যে চরম উৎকর্ষ, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। ১০০ বছর আগের পৃথিবী– প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝের যে-সময়– তখন থেকে গণকযন্ত্রের এবং দূরযোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে পুরোদমে। বিভিন্ন দেশ সেখানে পয়সা ঢেলেছে। তার ফল, যদি তাকে ‘ভাল’ বলে ধরা হয়, ভোগ করছে এখনকার পৃথিবী। উল্টো যুক্তি বলবে ঠিক আছে, কিন্তু চঁাদে মানুষ পাঠানোর খরচটা একটা দেশ কেন করবে? চঁাদে কি পালং শাক চাষ হবে? এই ধরনের যে-যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি তার মধ্যে দিয়েই এগয় রাষ্ট্রব্যবস্থা, এবং স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের, বিশেষ করে শাসকের।
সেই জায়গায় দেশনেতা ঠিক কতটা নিজের কথা ভাবছেন, কতটা দলের, কতটা নিজের দেশের আর কতটা পৃথিবীর, সেই বিচার হতে অনেকটা সময় লাগে। তাত্ত্বিক গবেষণার অনেক কিছুই ভবিষ্যতে কাজে লাগে না। সেক্ষেত্রে সেই ধরনের গবেষণায় পয়সা কম ঢেলে শক্ত অঙ্ক কষা বন্ধ করে দেওয়াই যায়। কিন্তু কয়েক কোটি অঙ্কের মধ্যে যে একটা-দুটো অঙ্ক হয়তো দুনিয়াটাকে আগামীতে বদলে দিত, সেই অঙ্কটার যদি রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে কষে ওঠার আগেই ভ্রূণহত্যা হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ট্রাম্প কতটা জনপ্রিয়– সেই রাশিবিজ্ঞান খুব কাজে আসবে না। অর্থাৎ ঠুনকো জনপ্রিয়তা অথবা নির্বাচনী রাজনীতির সফলতা আগামী বিশ্বব্যবস্থার খুব উন্নতি করবে, এমনটা নয়। ট্রাম্পকে নিয়ে মুশকিল সেখানেই।
অর্থাৎ যে-দেশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বকে দিশা দেখায়, সারা দুনিয়ার সেরা গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং প্রযুক্তিবিদরা যে-দেশে গিয়ে শ্রেষ্ঠ গবেষণাগারে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন সারাক্ষণ, সেখানে ট্রাম্পের ভাবনা বিষয়টিকে গুলিয়ে দিয়েছে। তঁার সংজ্ঞার গ্রেটনেস বড় বেশি ব্যবসায়িক এবং অগভীর বলে মনে হচ্ছে আমেরিকার এবং বিশ্বের বড় অংশের বুদ্ধিজীবীদের। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ কমানো বা বিজ্ঞানী ও গবেষক নিয়োগে দেরি শুধু সরকারি কাঠামোর ভিতরে সমস্যার সৃষ্টি করে না, বরং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও উদ্ভাবনের গতিবেগও শ্লথ করে দেয়। সেই কারণেই নাসার ক্ষেত্রে মহাকাশ গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যখন হ্রাস করা হয়, তখন শুধু মার্কিন দেশের গবেষকদের নয়, সারা দুনিয়ার বিজ্ঞানীদের কাছে বিষয়টি হতাশার। এর সঙ্গে আছে জটিল পুঁজিবাদী হিসাবনিকাশ।
ইলন মাস্কের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে, যার প্রভাব অবশ্যই নেতিবাচক। দেশনেতার কার্যকলাপ যদি রদ্দিমার্কা টুইটে সীমাবদ্ধ থাকে, ভিসার খরচ যখন হঠাৎ করে এক লক্ষ ডলার হয়ে যায়, প্রতি মুহূর্তে জন্মাতে থাকে হাস্যরসাত্মক শিরোনাম– তখন তার গভীরে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খুঁজে বের করা সাধারণভাবে শক্ত। কিন্তু মার্কিন দেশ তো বিশ্বের সেরা, এমনটা হতেই পারে যে, ট্রাম্পকে সামনে রেখে কোনও এক দুর্দান্ত আগামীর পরিকল্পনা চলছে, যেটাকে আমরা ভাবছি ঠুনকো ষড়যন্ত্র। নাসার বাজেট কমালেও ট্রাম্প সাহেব তো মহাকাশচারীদের জলে ফেলে দেননি! শিব ঠাকুরের আপন দেশে সেগুলো এখনও বনবন করে ঘুরছে! ট্রাম্প সাহেব মার্কিন দেশের তথা আগামীর এক সুস্থ জগতের বোঝা, না কি সেটা আমাদের বোঝার সীমাবদ্ধতা– সেটা বোঝার জন্য সময় মাগা ছাড়া গতি নেই।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.