Advertisement
Advertisement

Breaking News

Ladakh

বরফে আগুনের গন্ধ! ধিকিধিকি জ্বলছে ভারতের ‘মুনল্যান্ড’

প্রতিশ্রুতির কুমির ঝোলা থেকে বের করেও তা রক্ষায় উদাসীন মোদি সরকার।

Sonam Wangchuk's arrest is raisinf many question in Ladakh

ফাইল ছবি

Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 8, 2025 7:20 pm
  • Updated:October 8, 2025 7:20 pm   

লাদাখকে বারবার ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার প্রতিশ্রুতির কুমির ঝোলা থেকে বের করেও তা রক্ষায় উদাসীন মোদি সরকার। নিরুত্তর তরুণদের চাকরি প্রসঙ্গেও। তার উপর বিনা নোটিসে লাদাখি পরিবেশবিদ-বিজ্ঞানী সোনম ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার যেন আগুনে ঘৃতাহুতি। ধিকিধিকি জ্বলছে ভারতের ‘মুনল‌্যান্ড’। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ভোল বদলের নমুনা, অন্যভাবে বললে দুম করে ‘সুয়োরানি’ থেকে ‘দুয়োরানি’-তে রূপান্তরের নজির দেখতে চাইলে লাদাখের দিকে তাকাতে হবে। মোদি সরকারের ‘নয়নের মণি’ সোনম ওয়াংচুকের অচিরেই ‘চোখের বালি’ হয়ে যাওয়া পি. সি. সরকার সিনিয়রকেও অবাক করবে। এমন ভোজবাজি তিনিও হয়তো দেখাননি।

সোনমের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমোর হেবিয়াস করপাস আবেদন গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিস দিয়েছে। শীর্ষ আদালত কতটা কী করবে সেই অনুমান বৃথা। জানি না, বাস্তবের ‘র‍্যাঞ্চো’ সোনম ওয়াংচুকের ললাটে কী লেখা আছে। শঙ্কার কারণ, এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ সচেতক যে-আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই জাতীয় নিরাপত্তা আইনে (‘ন‌্যাশনাল সিকিউরিটি অ‌্যাক্ট’ বা ‘এনএসএ’) তঁাকে বিনা বিচারে বিনা জামিনে এক বছর কারাগারের অন্তরালে রেখে দেওয়া যায়। এই ধরনের আইনেই পঁাচ বছর ধরে জেলে থেকেছেন ভীমা কোরেগঁাও মামলার অভিযুক্তরা। দিল্লি দাঙ্গায় জড়িত বলে দাগিয়ে দেওয়া মানুষগুলো এখনও জেলে পচছেন। সরকার চাইলে এবং সর্বোচ্চ আদালতের কৃপা না-হলে সোনমের হালও তেমন হতে পারে। কারণ, সরকারি বয়ানে তিনি ‘পাকিস্তানের চর’। মানে ‘দেশদ্রোহী’। রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক।

অথচ, এই মানুষটির আদলেই তৈরি হয়েছিল আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’। পর্দার ফুংসুক ওয়াংড়ু বা ‘র‍্যাঞ্চো’, বাস্তবের সোনম ওয়াংচুক দেশের জন্য কী করেননি? তুষারাচ্ছাদিত লাদাখে সেনানীদের জন্য এমন ঘর তৈরি করেছেন, যেখানে উষ্ণতার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োজন হয় না। ফলে পরিবেশ দূষিত হয় না। এমন ধরনের কৃত্রিম হিমবাহ বা বরফের স্তূপ তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যা অসময়ে পানীয় ও সেচের জলের জোগান দেয়। এই মানুষটিই ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়গান করেছিলেন। লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কেন্দ্র ও বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের শিক্ষা সম্পর্কিত কমিটির পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টা থাকা সেই মানুষটিই এখন হঠাৎ দেশের নিরাপত্তার পক্ষে ‘বিপজ্জনক ও অনিরাপদ’ হয়ে গেলেন! মোদি জমানার রাজনীতি কী ভীষণ ও ভয়ংকর!

এই রূপান্তরের উত্তর খুঁজতে লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাস ও পরিবেশগত ঝুঁকির দিকে তাকাতে হবে। জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ মিলে গঠিত হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য। জন্মলগ্ন থেকেই তার চরিত্র ছিল আলাদা। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ তাদের বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। আলাদা সংবিধান ছিল। আলাদা পতাকা ছিল। স্থায়ী বাসিন্দারাই সেখানে জমি কিনতে পারত। সরকারি চাকরি পেত। ব্যবসা করতে পারত। রাজ্য সরকারের অনুমোদন ছাড়া কেন্দ্রীয় আইন সেখানে বলবৎ হত না। বিজেপি ২০১৯ সালে সেই বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে রাজ্য ভেঙে গঠন করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা জিইয়ে রাখা হয়। বলা হয়, ঠিক সময় তাদের রাজ্যের মর্যাদা ফেরানো হবে। কিন্তু লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলই রাখা হবে।

সেই সিদ্ধান্তকে লাদাখিরা স্বাগত জানিয়েছিল। তার কারণও ছিল। হিন্দুপ্রধান জম্মু ও সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার রাজনৈতিক দাপট ও প্রভাবে বৌদ্ধ প্রধান লেহ্ এবং শিয়া মুসলমান প্রধান কারগিল কুঁকড়ে থাকত। ৮৭ সদস্যের বিধানসভায় লাদাখের প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র চারজন। তঁারা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। কোনওভাবেই তঁারা জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে পেরে উঠতেন না। নিজেদের বঞ্চিত মনে করতেন। বারবার তাই তঁারা লাদাখকে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি জানিয়েছেন। রাজ্য দ্বিখণ্ডীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই কারণেই বিজেপির পক্ষে সহজ হয়ে গিয়েছিল। আপামর লাদাখির সমর্থন মিলেছিল।

কিন্তু ক্রমেই তঁারা বুঝতে পারলেন, তঁাদের চাহিদা মেটানোর বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় কেন্দ্রের নেই। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। নির্বাচনী ইস্তেহারেও তার উল্লেখ ছিল। সেই প্রতিশ্রুতি বিজেপিকে লাদাখের একমাত্র লোকসভা আসনটি পাইয়েও দিয়েছিল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সময়েও বিজেপি সেই প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে এ নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই।
পরিস্থিতি বদলে যায় ২০২০ সালে, গলওয়ান সংঘর্ষের পর। লাদাখিরা বুঝতে পারে, চিনের কাছে ভারত জমি হারিয়েছে। লোকসভায় তার উল্লেখ করে বিজেপি সদস্য জমিয়াল শেরিং নামগিয়াল বিজেপির কুনজরে পড়ে যান। ক্রমেই লাদাখিরা বুঝতে পারে, বিমাতৃসুলভ মনোভাব সত্ত্বেও ৩৭০ অনুচ্ছেদ তাদের রক্ষাকবচ ছিল। জমি ও চাকরির উপর লাদাখিদের যে অধিকার ছিল, সেই রক্ষাকবচ কর্পূরের মতো উবে গেল। জমি বেহাত হওয়া ঠেকানো যাবে না। অন্য ভারতীয়রা ক্রমেই জঁাকিয়ে বসবে। চাকরিতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। শিল্পায়নের ফলে রসাতলে যাবে পরিবেশ। নষ্ট হবে লাদাখি সংস্কৃতি ও যাবতীয় বৈশিষ্ট‌্য।

বিপদটা কত মারাত্মক, ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হতে না-পারা কোন সর্বনাশের কারণ হয়ে দঁাড়াবে, লাগামছাড়া শিল্পায়ন লাদাখের পরিবেশকে কোন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, সোনম ওয়াংচুকই প্রথম তা তুলে ধরেন। শুরু হয়, তঁার ‘অনশন সত্যাগ্রহ’। গান্ধীজির দেখানো পথে। লেহ্‌-র বৌদ্ধ ও কারগিলের শিয়া মুসলমানদের রাজনৈতিক দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনিই তাদের জোটবদ্ধ করে তোলেন। দুই সম্প্রদায়ই বুঝতে পারে, বিপদ কত ভয়ংকর এবং জোটবদ্ধতা কতটা প্রয়োজনীয়। ‘অ্যাপেক্স বডি অফ লেহ্’ (এবিএল) এবং ‘কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ (কেডিএ) এই মুহূর্তে সব দূরত্ব ঘুচিয়ে একজোট হয়ে পঁাচ দফা দাবিতে আন্দোলনে শামিল। পৃথক রাজ্য, নিজস্ব বিধানসভা, ষষ্ঠ তফসিলের মর্যাদা, পৃথক সার্ভিস কমিশন এবং লেহ্ ও কারগিলের জন্য দু’টি লোকসভা কেন্দ্রের দাবিতে এখন তারা অনড়। কেন্দ্রের সঙ্গে এবিএল ও কেডিএ-র আলোচনা স্থগিত রাখা হয়েছে। দুই সংগঠনই জানিয়েছে, সোনম ওয়াংচুক-সহ ধৃত সবার নিঃশর্ত মুক্তি ও ২৪ সেপ্টেম্বরের হিংসাত্মক ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোনও আলোচনা নয়।

লাদাখের ‘জেন-জি’ এখন কেন অস্থির এই প্রশ্নের সহজ উত্তর: ভূমিপুত্রদের চাকরির অভাব। লাদাখিরা আগে গোটা জম্মু-কাশ্মীরে চাকরির সুযোগ পেত। এখন অধিকাংশ নিযুক্তি চুক্তিভিত্তিক। সেনাবাহিনীতেও। ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প হতাশা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত না-হলে উপজাতি অধ্যুষিত লাদাখের জমি ও চাকরি ভিনরাজ্যের মানুষের কাছে চলে যাবে। চিন্তা তো হবেই।

উপরাজ্যপাল কবীন্দ্র গুপ্ত বলেছেন, চাকরির জন্য শিল্প চাই। শিল্পের জন্য লগ্নি চাই। লাদাখে একটা সৌর বিদ্যুৎ পার্ক করার প্রস্তাব বিবেচিত হচ্ছে। সেটা যেখানে করা হবে, সেই প্যাং এলাকা মেষপালকদের চারণভূমি। ওই ভেড়ার লোম থেকেই তৈরি হয় বিখ্যাত পশমিনা। শিল্পের জন্য প্যাং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পরিবেশ বিপন্ন হবে। গোটা প্রকল্পে কর্মসংস্থান হবে ৪৫ হাজার জনের, যেখানে প্যাংয়ের জনসংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার। এর মানে প্রকল্পের বাকিরা হবে বহিরাগত। তাদের জন্য বাসস্থান যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন জলের। অথচ লাদাখিদের নিত্য লড়াই জলের জন্য।

সৌরশক্তির মতো শিল্পপতিদের দৃষ্টি রয়েছে বিরল খনিজ সম্পদের উপরেও। সোনম-সহ সব পরিবেশবিদ লাগামছাড়া শিল্পায়নের বিরোধিতা করে বলেছেন, লাদাখের পরিবেশ বিপন্ন হলে ভারত রসাতলে যাবে। উন্নয়নের নামে উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের সর্বনাশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা সোনম বারবার বলে চলেছেন। শিল্পবান্ধব মোদি সরকারের তা পছন্দ হওয়ার নয়। ‘নয়নের মণি’ থেকে রাতারাতি তাই তিনি ‘চোখের বালি’।

মোদি-নীতি মণিপুরকে অশান্ত করেছে। লাদাখও সেই পথে হঁাটলে ঈশ্বর ভরসা। ভুললে চলবে না, লাদাখের একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে চিন। মণিপুরের অশান্ত থাকা ও লাদাখের শান্তিভঙ্গের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত।

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ