প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাও এই তত্ত্ব দিয়ে করা যায়। যেমন, পারমাণবিক আকর্ষণ থাকার জন্যে প্রোটন বা নিউট্রনের পরমাণুর বাইরে চলে আসা দুষ্কর হওয়ার কথা। তা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কম শক্তিসম্পন্ন আলফা কণা (যা কিনা দু’টি প্রোটন ও দুটি নিউট্রনের সমষ্টি) পরমাণু বা নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। লিখছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পারঙ্গমা সেন।
মনে করা যাক, একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা মাঠে বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে। এবার ব্যাটার বলটা খুব জোরে মারলে তবেই সেটা পাঁচিল টপকে বাইরে চলে যেতে পারে, কিংবা বড়জোর পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। বল খুব জোরে মারলে তার শক্তি বা এনার্জি বেশি থাকে তাই সেটা বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এনার্জি কম থাকলে এমন কি সম্ভব যে বলটা পাঁচিল টপকাতে পারল না। কিন্তু পাঁচিল অক্ষত রেখে সেটি ভেদ করে বাইরে চলে গেল? সাধারণ বুদ্ধি বলছে, কখনই সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার হল, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এরকমটা কিন্তু হতেই পারে। যদি বলের বদলে খুব ছোট কোনও পদার্থ হয়, যেমন ইলেকট্রন, সেক্ষেত্রে কম শক্তিসম্পন্ন কণাটিও কোনও কোনও বার ধাক্কা খেয়ে ফিরে না এসে দেওয়াল ভেদ করে বাইরে চলে যাবে!
কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করে এটা সহজেই দেখানো যায়। কিছু প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাও এই তত্ত্ব দিয়ে করা যায়। যেমন, পারমাণবিক আকর্ষণ থাকার জন্যে প্রোটন বা নিউট্রনের পরমাণুর বাইরে চলে আসা দুষ্কর হওয়ার কথা। তা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কম শক্তিসম্পন্ন আলফা কণা (যা কিনা দু’টি প্রোটন ও দুটি নিউট্রনের সমষ্টি) পরমাণু বা নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এই রকম ঘটনাকে বলা হয় ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’। অতি ছোট কণার ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব কারণ তাদের চরিত্র ওই ক্রিকেট বলটা থেকে অনেকটাই আলাদা। সামান্য কথায় বলা যেতে পারে, এই অতি ছোট কণার একটা তরঙ্গর মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেটা বলটার ক্ষেত্রে নগণ্য। তাহলে কি যেসব জিনিস দেখতে মাইক্রোস্কোপ লাগে না, খালি চোখেই দেখা যায়, তাদের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম টানেলিং দেখা সম্ভব নয়? অথবা প্রশ্নটা ঘুরিয়ে এরকম করা যায়, একটির বদলে অনেকগুলি কণার টানেলিং দেখা কি সম্ভব, যাকে এক কথায় ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং বলা যায়?
এবারে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারবিজয়ী তিন বিজ্ঞানী গত শতাব্দীর আশির দশকে একাধিক পরীক্ষা করে এর উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন- হ্যাঁ, সম্ভব। এই তিন বিজ্ঞানী জন ক্লার্ক, মাইকেল ডেভরেট এবং জন মারটিনিস দুটো সুপারকন্ডাক্টর দিয়ে একটি বিশেষ ইলেকট্রিকাল সার্কিট তৈরি করেন। সুপারকন্ডাক্টর হচ্ছে এমন একটি পদার্থ যা কিনা একটি বিশেষ তাপমাত্রার নিচে প্রতিরোধহীন ভাবে বিদ্যুৎ পরিবহণ করতে পারে, অর্থাৎ তার রেজিস্ট্যান্স তখন শূন্য। এরকম দুটো সুপার কন্ডাক্টর নিয়ে তাদের মাঝখানে একটি সঙ্কীর্ণ অন্তরক বা ইনসুলেটর রাখা হল। এই ধরনের গঠনকে জোসেফসন জাংশন বলা হয়ে থাকে।
সুপারকন্ডাক্টরের বিশেষত্ব হল, এর মধ্যে দু’টি ইলেকট্রন একজোট হয়ে একটি একক কণার মতো আচরণ করে যার নাম দেওয়া হয় কুপার পেয়ার (Cooper pair)। এবং সব কুপার পেয়ারগুলো, যা কিনা সংখ্যায় কয়েকশো কোটি, সবাই মিলে একটি একক পদার্থর মতো বিদ্যুৎ পরিবহণ করে, অর্থাৎ ইলেকট্রনগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য আর থাকে না, সব মিলিয়ে তারা একটি বড় বস্তু, যা ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে অধিকার করে থাকে, তার সমতুল্য হয়ে যায়। এবং পরীক্ষা থেকে দেখানো হয় যে এই সার্কিটটিতে ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’ ঘটার ইঙ্গিত সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে। মাঝের ওই অন্তরকটি এখানে দেওয়ালের কাজ করছে, যা “ভেদ”করে টানেলিং ঘটছে। সুতরাং এই পরীক্ষা থেকে প্রথম দেখানো হল ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব, যেটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃসন্দেহে।
একশো বছর আগে মূলত হাইজেনবার্গ ও শ্রডিঙ্গারের হাতে তৈরি কোয়ান্টাম মেকানিক্স আরও বেশ কিছু ধ্রুপদী ধ্যানধারণা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী একটি বস্তুর শক্তির মান অবিচ্ছিন্ন হতে পারে, কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী শক্তির মান হবে quantised, অর্থাৎ তা বিশেষ কিছু বিচ্ছিন্ন মানই কেবল নিতে পারবে। এবারের পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ীরা তাঁদের পরীক্ষাগুলি থেকে এটাও দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯৮৫ সালে ছোট দু’টি গবেষণাপত্র, লেটারের আকারে এবং আরও পরে বড় গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এই তিন বিজ্ঞানী, যার ভিত্তিতে এই নোবেল পুরস্কার। ক্লার্ক, ডেভরেট এবং মারটিনিস বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে অধ্যাপক, পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ও পি এইচ ডি ছাত্র ছিলেন সেই সময়ে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.