বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে– ভারতের চরম দারিদ্র নাকি কমে গিয়েছে। জিডিপি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বলছে– ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ শতাংশে। এদিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কও রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এত কিছু করেও কি বেসরকারি লগ্নি বাড়বে? সুতীর্থ চক্রবর্তী।
দেশের অর্থনীতি সংক্রান্ত পরপর কয়েকটি খবর বেশ আলোড়ন তুলেছে। সর্বশেষ অবশ্যই বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটি, যেখানে বলছে ভারতের চরম দারিদ্র কমে গিয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের দেওয়া পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে: ২০১১-’১২ থেকে ২০২২-’২৩ সালের মধ্যে ২৬.৯ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র থেকে মুক্ত করা গিয়েছে। চরম দারিদ্রের হার ২৭.১ শতাংশ থেকে কমে ৫.৩ শতাংশ হয়েছে। এই দারিদ্র কমার ক্ষেত্রে বাংলার ভূমিকাকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটি অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে শ্লাঘার। কারণ বিশ্ব ব্যাঙ্ক যে সময়-কাল নিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে, সে-সময় রাজ্যে তৃণমূলের সরকার রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার গরিব মানুষের জন্য রাজ্যে যে সামাজিক সুরক্ষার বলয় তৈরি করতে পেরেছে, তা অনন্য। নানারকম সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব মানুষের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়া মমতা সরকারের লক্ষ্য থেকেছে। দারিদ্র দূরীকরণ করার এর চেয়ে ভালো কোনও পন্থা হতে পারে না। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে তারই স্বীকৃতি মিলেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ভারতে দারিদ্র কমার কারণ হিসাবে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিককে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য দেওয়ার প্রকল্পের উল্লেখ করেছে। এটাও ঘটনা যে, কোভিডের সময় প্রকল্পটি সারা দেশে চালু হলেও বাংলায় এই ধরনের প্রকল্প আগে থেকেই সফলভাবে চলছিল। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-সহ তৃণমূলের একাধিক প্রকল্প যে অন্য রাজ্য অনুসরণ করছে, তা নতুন কোনও খবর নয়। বস্তুত, ভারতের মতো জনবহুল ও দরিদ্র দেশে সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে গরিব মানুষকে অর্থ ও খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়া ছাড়া উন্নয়নের কোনও ‘বিকল্প’ মডেলও নেই। সরকার এটা করতে পারলে ধীরে-ধীরে বাজারের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। বাংলা-সহ বেশ কিছু রাজ্যে সেটা ঘটছেও।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট সামনে আসার কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে জিডিপি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান। ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ শেষ হওয়া আর্থিক বছরে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ শতাংশ। কোভিডের পর আর্থিক বৃদ্ধির হার এতটা কম হয়নি। ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে যাওয়ার কারণ হল, উৎপাদন শিল্প তথা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে মন্দা। কৃষিতে গত কয়েক বছর ধরেই ভাল বৃদ্ধি ঘটছে। গত অার্থিক বছরে কৃষিতে বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৪ শতাংশ। পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের উপর ছিল। কিন্তু উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধি না ঘটলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। উৎপাদন শিল্প শ্রম নিবিড়। উৎপাদন শিল্পে কাজের সুযোগ তৈরি হয় অনেক বেশি। একদিকে চরম দারিদ্র কমছে, কিন্তু অন্যদিকে উৎপাদন শিল্পে মন্দার কারণে দেশে কাজের সুযোগ কমছে। কর্মসংস্থান কম হওয়ায় বাজারে পণ্যের চাহিদাও কম। এই কম চাহিদার দুষ্টচক্র থেকে ভারতের অর্থনীতি কিছুতেই বেরতে পারছে না।
জিডিপি পরিসংখ্যান প্রকাশের হাত ধরেই এল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ৫০ বেসিস পয়েন্ট রেপো রেট কমানোর অপ্রত্যাশিত ঘোষণা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটি তাদের সর্বশেষ বৈঠকে রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২ মাস অন্তর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটি বৈঠকে বসে। জুন মাসের বৈঠকের আগে এ-বছরের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাসে মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক হয়েছিল। ওই দুই বৈঠকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট করে রেপো রেট কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সবমিলিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন, মাত্র ৪ মাসে রেপো রেট কমল ১০০ বেসিস পয়েন্ট। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের যে-হারে বাণিজি্যক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ দেয়, তাকে ‘রেপো রেট’ বলে। অর্থাৎ, গত চারমাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক শতাংশ সুদ কমিয়ে দিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক শতাংশ সুদ কমানোয় বাণিজি্যক ব্যাঙ্কগুলিও এবার তাদের সুদ কমাতে শুরু করবে। সুদ কমানোর সবচেয়ে বড় সুবিধা পান শিল্পোদ্যোগীরা। এঁরা ব্যাঙ্ক থেকে মোটা মোটা টাকা ঋণ করে লগ্নি করেন। সুদ কমলে তাঁদের লগ্নির খরচ কমে। বেসরকারি লগ্নি আকর্ষণ করতেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এক ধাক্কায় এতটা সুদ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। শুধু সুদ কমানো-ই নয়, বেসরকারি লগ্নিতে সুবিধা করে দিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবারের মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের হাতে অতিরিক্ত নগদের জোগান সুনিশ্চিত করেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের মোট আমানতের একটি অংশ রিজার্ভ ব্যাঙ্কে নগদে জমা রাখতে হয়। এই টাকা তারা ঋণ দিতে পারে না। এটিকে ‘নগদ জমার অনুপাত’ বলে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের মোট আমানতের ৪ শতাংশ নগদ জমার অনুপাত হিসাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা রাখতে হয়। মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই নগদ জমার অনুপাত চারটি কিস্তিতে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের লক্ষ্য– ডিসেম্বরের মধ্যে নগদ জমার অনুপাত ১ শতাংশ কমিয়ে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা নগদের জোগান বাড়ানো। এই আড়াই লক্ষ কোটি টাকা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি বেসরকারি লগ্নির জন্য সরবরাহ করবে।
সুদ কমানো হল– ব্যাঙ্কের হাতে নগদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা, কিন্তু তাতেও কি বেসরকারি লগ্নি বাড়বে? এটাই এখন সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্ন। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট কর অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। তখনও লক্ষ্য ছিল বেসরকারি লগ্নি বাড়ানো। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থা বা শিল্পোদ্যোগীরা তাতে সাড়া দেননি। কেন্দ্রীয় সরকার পরিকাঠামোয় লগ্নি বাড়িয়েছে। অর্থনীতিতে বলে– সরকারি লগ্নি বেসরকারি লগ্নিকে টেনে আনে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এটাও সফল হয়নি। শিল্পোদ্যোগীরা চাহিদার সংকটের কথা বলে থাকেন। চাহিদা বাড়াতেও সরকার ধারাবাহিক পদক্ষেপ করেছে। এবারে আয়করে মধ্যবিত্তকে বিরাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। ১২ লক্ষ টাকা আয় পর্যন্ত করের বালাই নেই। করদাতাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ। রেপো রেট কমার সুবিধাও মধ্যবিত্তর একটা বড় অংশ পাবে। বাড়ি, গাড়ি-সহ সমস্ত ইএমআই এবার কমবে। এতকিছুর পরেও এখনও বেসরকারি লগ্নিতে সেভাবে টান নেই।
এখন বলা হচ্ছে, রপ্তানি বাড়লে বেসরকারি লগ্নি আসবে।
ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য কমছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক বাড়ানোর নীতি পরিস্থিতি জটিল করেছে। ব্রিটেন-সহ কিছু দেশের সঙ্গে ভারত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছে। কিন্ত সেসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে এখন তাকিয়ে থাকা শুধু রেপো রেট ও নগদ জমার অনুপাত কমার নীতি অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলে তার দিকে। প্রতিক্রিয়াটা চাহিদার দিক থেকেই আসতে হবে। ব্যাঙ্কের সহজলভ্য ঋণ যদি ধার করে ঘি খাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে অবশেষে কেল্লা ফতে হতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.