Advertisement
Advertisement
Frederick Mccarthy Forsyth

ফ্রেডরিক ম্যাকার্থি ফরসাইথ, যিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা, তিনিই বেস্টসেলার লেখক

কাজ করেছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআই সিক্স’-এ।

Life and work of Frederick Mccarthy Forsyth
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:June 14, 2025 8:48 pm
  • Updated:June 14, 2025 8:48 pm  

ফ্রেডরিক ম্যাকার্থি ফরসাইথ বিখ্যাত হয়েছেন ফিকশন লিখে। ‘বিবিসি’-র ‘ফরেন করেসপনডেন্ট’ হয়ে পূর্ব ইউরোপে ছিলেন। কাজ করেছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআই সিক্স’-এ। পরে যখন একের-পর-এক বেস্টসেলার লিখেছেন, বাস্তবানুগ তথ্যের জন্য জান কবুল করতে বিরত হননি। ৯ জুন প্রয়াত হলেন।  লিখছেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

জটায়ু যেরকম গল্প লিখতেন, তাতে তোপসের মনে হয়েছিল– ‘লোকটার চেহারা নিশ্চয়ই হবে একেবারে জেমস বন্ডের বাবা’। তা-ই চোখের সামনে প্রথমবার ভদ্রলোকের চেহারা দেখে– তার হাসি পেয়ে গিয়েছিল। এমনটা কিন্তু ঘটার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না ফ্রেডরিক ফরসাইথের ক্ষেত্রে। কারণ, ভদ্রলোকের চেহারা নায়কোচিত সুদর্শন। কমবয়সে হয়তো জেমস বন্ডের ভূমিকাতেও মানিয়ে যেত। অথচ জটায়ুর ব্যাপারটা গল্পে ঘটেছিল আর ফরসাইথের ঘটনা বাস্তব। এরকম কারণের জন্যই বোধহয় ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ কথাটার সৃষ্টি।

ফ্রেডরিক ম্যাকার্থি ফরসাইথ বিখ্যাত হয়েছেন ফিকশন লিখে। কিন্তু বাল্যকাল থেকেই ‘স্ট্রেঞ্জ’ ঘটনা বা বিষয় তঁার নজরে যত এসেছে বা যেমন ঘটনায় নিজে স্বেচ্ছায় বা অজান্তে জড়িয়ে পড়েছেন, তাতে তঁার জীবনটাও যেন লেখা কাহিনিগুলির মতোই রোমাঞ্চকর। শৈশবে দেখেছেন কেন্টের অ্যাশফোর্ডে বাড়ির বাগানের প্রান্তে রাস্তায় আমেরিকান ট্যাঙ্ক দঁাড়িয়ে থাকতে। আলাপ জমানোর চেষ্টা করলেও মিলিটারি নিয়মে বাধ্য টমি সৈনিক খুব একটা সাড়া দিতে পারেনি বছর আটেকের ছোট্ট ছেলেটির উৎসাহে। তবে বেশ কয়েক দিন বাড়ির সামনে উপস্থিত সৈনিকের কাছ থেকে একা-আধটা চকোলেট উপহার পেতে বাধা ছিল না ফ্রেডির।
স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় প্লেন চালাতে শেখা ছাড়াও ছুটিতে ‘স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ’ প্রকল্পে অংশ নিয়ে কখনও জার্মানি, কোনও বছর ফ্রান্স বা স্পেন অথবা পশ্চিম ইউরোপের অন্য দেশে গিয়ে সেই দেশের সমবয়সি ছাত্রদের পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আসতেন ফ্রেডরিক।

দেশ দেখার সঙ্গে আর যে প্রাপ্তি ঘটেছিল, তা হল: বিভিন্ন ভাষায় সড়গড় হয়ে যাওয়া। অধীত সেই ভাষাজ্ঞান কাজে লেগে গেল ‘বিবিসি’-র ‘ফরেন করেসপনডেন্ট’ হয়ে ইউরোপে, বিশেষত পূর্ব ইউরোপের শহরে, কাজ করতে গিয়ে। রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ফরসাইথ ‘বিবিসি’-র চাকরি নিয়েছিলেন, না কি ও-ই কাজ তঁাকে আকর্ষণ করেছিল রাজনীতির দিকে– বলা মুশকিল। কিন্তু যা-ই ঘটে থাকুক, ফরসাইথ শুধুমাত্র সংবাদদাতা,
সংবাদ-রচয়িতা বা খবরের ‘স্কুপ’ করে নাম কেনায় আটকে না থেকে নিজেকে আরও মেলে ধরে জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতির চক্রান্তের অন্ধিসন্ধি গোলকধঁাধায়।

পূর্ব জার্মানির বার্লিনে সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করার সময়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআই সিক্স’-এর হয়ে কাজ করেছেন ফরসাইথ। কতকটা যেন-বা বন্ড-সুলভ নায়কের মতোই পূর্ব জার্মানির কুখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা ‘স্ট্যাসি’-র সুন্দরী এজেন্টের সঙ্গে জড়িয়েছেন ক্ষণস্থায়ী রোম্যান্টিক সম্পর্কে। উত্তর আফ্রিকায় নাইজিরিয়ার গৃহযুদ্ধের খবর জোগাড় করতে গিয়ে অর্জন করেছেন বায়াফ্রার নেতা চুকুয়েমেকা ওদুমগুয়ে ওজুকোয়ু-র (ডাকনাম এমেকা) বন্ধুত্ব। বায়াফ্রা ও নাইজিরিয়া যুদ্ধে যেভাবে মানসিকভাবে ফরসাইথ জড়িয়ে পড়েছিলেন বায়ফ্রার তরফে, তার সঙ্গে তুলনা চলে স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের সমর্থক হয়ে সাংবাদিক হিসাবে আমেরিকা থেকে আসা আর্নস্ট হেমিংওয়ের জড়িয়ে পড়ার। সেবার নাইজিরিয়ায় এক বন্দুকের লড়াইয়ের মাঝে পড়তে হওয়ায় মাথার চুলের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিল একটি বুলেট। দরজার ফ্রেমে বিঁধে থাকা বুলেটটি পরে উদ্ধার করেন ফরসাইথ, আর আজীবন সঙ্গে রেখেছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে।

আবার, চাকরির বঁাধা-ধরা গণ্ডিতেও আটকে থাকতে পারেননি। বিশ্ব-রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তার সঙ্গে কল্পনাশক্তির প্রয়োগে লিখে ফেলেন ‘ডে অফ দ্য জ্যাকল’ (১৯৬৯) আর ‘দ‌্য ওডেসা ফাইল’-এর (১৯৭১) মতো দু’খানা জবরদস্ত উপন্যাস, যেগুলি শুরু থেকেই বেস্টসেলার। তারপর শুরু করেছিলেন ‘দ্য ডগস অফ ওয়ার’ বইটির জন্য গবেষণা। তারই অঙ্গ হিসাবে এক ভাড়াটে সৈন্যদলের এজেন্টের ছদ্মপরিচয়ে বেআইনি অস্ত্রর খরিদ্দার সেজে হাজির হয়েছিলেন হামবুর্গের এক অস্ত্রের চোরাকারবারির গোপন আড্ডায়। উদ্দেশ্য ছিল: এই ব্যবসায় অস্ত্র কীভাবে পাচার করে, বেআইনিভাবে টাকা নেয় কোন পদ্ধতিতে এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে ‘ফার্স্টহ্যান্ড’ খবর জোগাড় করা, যাতে উপন্যাসে সেই তথ্য ব্যবহার করা যায়। কাহিনিতে ভুল, কাল্পনিক বা অবাস্তব তথ্য ব্যবহার করা পছন্দ করতেন না ফরসাইথ। সেবার ওই চোরাকারবারির কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে বেরনোর কিছুক্ষণের মধ্যে যে লোকটি মারফত অস্ত্র-ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ
করা গিয়েছিল, সে খবর দিয়েছিল

অস্ত্র-ব্যবসায়ী লোকটি ফরসাইথের আসল পরিচয় জেনে গিয়েছে–‘দ‌্য ওডেসা ফাইল’-এর জার্মান অনুবাদে লেখকের ছবি দেখে। এসব চোরাকারবারিরা ব্যবসার প্রয়োজনে খুন-জখমে পিছপা হয় না। তাই সেদিন ভয় পেয়ে প্রায় তৎক্ষণাৎ শহর শুধু নয়, একেবারে জার্মানি ছেড়েছিলেন ফরসাইথ। ‘দ্য ডগস অফ ওয়ার’ কতখানি গবেষণার ফসল বইটির পাঠক মাত্রই জানে। একটি ছোট আফ্রিকান রাষ্ট্রে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করানো ছিল এই উপন্যাসের অন্যতম বিষয়বস্তু। বইটি প্রকাশের পর রটে গিয়েছিল লেখক নাকি ঘটনাটি বিশদে এবং বাস্তবসম্মতভাবে লিখতে নিজেই ওইরকম একটি দেশে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন!

একজন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হিসাবেও গণ্য করা যায় ফরসাইথকে। ‘দ্য ডেভিল্‌স অল্টারনেটিভ’ কাহিনিতে তঁার লেখা একটি বিবরণের কারণে। উপগ্রহ মারফত শত্রু দেশের উপর নজর রাখা তখন সদ্য চালু হয়েছে। ফরসাইথের কল্পনায় দেখা গিয়েছিল, মার্কিন উপগ্রহের ক্যামেরায় ধরা পড়ছে আফগান সীমান্তে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর জড়ো হওয়ার ছবি। ঘটনাটি কাহিনির বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত না-হলেও রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন ফেলেছিল। কারণ ওই কাহিনি প্রকাশের ক’দিন পরই সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। রাজনীতিবিদরা ভেবে কুলকিনারা পাননি ফরসাইথ সোভিয়েত অনুপ্রবেশের অনেক আগে কীভাবে বিষয়টি জানলেন বা অনুমান করলেন।

জীবনের পঞ্চাশটি বছর পার করে সাময়িকভাবে লেখালিখির চাপ কমিয়ে শান্তির জীবন কাটানোর জন্য হার্টফোর্ডশায়ারে একটি খামার কিনে সেখানে বসবাস শুরু করেছিলেন ফরসাইথ। অবশ্য লেখা একেবারে ছাড়তে পারেনি। ১৯৯০ সালে, এর বছর দুই আগে প্রথম স্ত্রী-র সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সদ্য দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেছেন– তখনই খবর এসেছিল আজীবনের সঞ্চিত অর্থ যেখানে বিনিয়োগ করে রেখেছেন– সেই সংস্থা দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। আবার নতুন করে রোজগার শুরু করতে হয়েছিল তখন। তবে তার জন্য নিজের সৃষ্টির প্রতি নিষ্ঠা বা আন্তরিকতার অভাব ঘটেনি। যে-বিষয় নিয়েই লিখতেন, বিশদ গবেষণা করতেন। ফলে, বছরে একটির বেশি বই লিখতে পারার প্রশ্ন ওঠেনি। কখনও একাধিক বছরেও লেগে যেত একটি উপন্যাস সম্পূর্ণ করতে। ফলে রচিত বইয়ের সংখ্যা হয়তো বেশি নয়, কিন্তু প্রতিটিকে ‘সুপার বেস্টসেলার’ বললেও হয়তো কম বলা হয়।

হামবুর্গে অস্ত্রের চোরাকারবারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে যেমন বিপদে পড়তে হয়েছিল, ঠিক সেইরকম না হলেও লেখার প্রয়োজনে গবেষণা করতে গিয়ে বহুবার ঝামেলায় পড়তে হয়েছে ফরসাইথকে। ‘দ্য কোবরা’ বইটির জন্য ড্রাগ পাচারকারীদের ঘঁাটির অকুস্থল দেখতে পশ্চিম আফ্রিকার গিনি-বিসাউ দেশটিতে গিয়েছিলেন। সেখানে থাকাকালীন একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটেছিল সেই দেশে। তখন টেলিফোনে একদিন শ্রীমতি ফরসাইথ তঁার বন্ধুকে স্বামী ফ্রেডির ওই দেশে যাওয়ার কথা বলায় ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতর সেই উল্লেখ শুনে লেখকের স্ত্রী স্যান্ডিকে জেরা করতে চলে এসেছিল।

তার বছর তিনেক পর গিয়েছিলেন ডাকাত, ভাড়াটে যোদ্ধা, জলদস্যু অধ্যুষিত ক্রাইমের স্বর্গ হিসাবে পরিচিত সোমালিয়ার মোগাডিসু শহরে। হোটেলের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন ট্রেসার বুলেটের ছুটে যাওয়া বা ক্রাইমের চূড়ান্ত। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ফরসাইথের আত্মজীবনী ‘দ্য আউটসাইডার’। তারপর লিখেছেন ‘দ্য ফক্স’ উপন্যাস। সেটি প্রকাশিত হল লেখকের ৮০ বছর বয়সে। বয়স তঁাকে হয়তো বাধ্য করেছে জীবনের শেষাংশে ধীরে চলতে, তবে একেবারে থামাতে পারেনি। এক সহ-লেখককে নিয়ে ‘দ‌্য ওডেস ফাইল’-এর সিকোয়েল রচনার কাজ শেষ করে ফেলেছিলেন। তবে বইটির প্রকাশ আর দেখে যাওয়া হল না সেই ১৯৭১ থেকে পাঠকদের চমৎকৃত করে রাখা লেখকের।

জীবনে দু’টি কাজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ফ্রেডরিক ফরসাইথ। তার একটি, ইজরায়েল দেশটির ‘জনক’ ডেভিড বেন গুরিয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, যা তিনি করতে সক্ষম হয়েছিলেন লেখক-জীবন শুরু হওয়ার সময়ে। অন্যটি প্যারাশুট নিয়ে উড়ন্ত প্লেন থেকে হাওয়ায় ভেসে নেমে আসা। সেই স্বপ্ন সফল যখন হল, তখন ফরসাইথ সদ্য ৭৬তম জন্মদিন পার করেছেন। এমন বর্ণময় আর রোমহর্ষক জীবন এ-যুগের আর কোনও সাহিত্যিক পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
[email protected]

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement