Advertisement
Advertisement
PR Man Singh

মান সিং, তিরাশির বিশ্বজয়ের ৪২ বছর পর নামটা কি কেউ মনে রেখেছেন?

১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের প্রধান ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১০

২৫ জুন, ১৯৮৩। দিনটা ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয়। কারণ, দু'বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে কপিল দেবের ভারত। সেই ভারতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন পি আর মান সিং। সেই বিশ্বকাপ জয়ের ৪২ বছর পর এক্নটাই প্রশ্ন, নামটা কতজনের কাছে পরিচিত? হালফিলে বক্স অফিসে ‘৮৩’ ছবির কিছু দর্শক অবশ্য পরিচিত হয়েছেন নামটির সঙ্গে। এর বাইরে আমজনতা? ক্রিকেটপ্রেমীরা? অধিকাংশের তরফ থেকেই নেতিবাচক উত্তর আসবে।

১০

সংক্ষিপ্ত ক্রিকেটীয় কেরিয়ারের প্রায় একদশক পর পি আর মান সিং হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এহেন পি আর মান সিং ক্রিকেট বিশ্বে ‘মান সাব’ কিংবা ‘মিস্টার ক্রিকেট’ নামে পরিচিত। মান সাব ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের প্রধান ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

১০

টিম ম্যানেজারের তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে ক্রিকেটাররা শুধুমাত্র খেলায় মনোনিবেশ করতে পারেন। মান সিং একাই ১৯৮৩'র ভারতীয় দলের জন্য এমনটা করেছিলেন। যদিও এটা মান সিংয়ের কাছে সমস্যা ছিল না। কারণ এক্ষেত্রে তাঁর একটা সুবিধাও ছিল। তিনি ভারতীয় দলের ১৪ জন খেলোয়াড়কে কয়েক বছর ধরেই চিনতেন। যখন তাঁরা অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট খেলতেন, তখন তাঁরা হায়দরাবাদে আসতেন মঈন-উদ-দৌলা গোল্ডকাপ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় ম্যাচ খেলতে। হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা হিসেবে সেই ক্রিকেটারদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তাই বিশ্বকাপের আগে একটা পুরনো সমীকরণ ছিল তাঁদের মধ্যে।

১০

মান সিংয়ের জন্য আরেকটি সুবিধা হল, তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। সেখানে দু'বছর লিগ ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি। তাই ইংলিশ ক্রিকেট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ইতিমধ্যেই এমসিসি'র সদস্য হয়েছিলেন তিনি। তখন ক্রিকেটে এখনকার মতো এত টাকা ছিল না। আজকের মতো এত সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগে বোর্ড বেশি খরচ করতে পারেনি। মান সিং তাঁর আগে ওই পদে দায়িত্ব সামলানো মানুষদের সঙ্গে একজন ম্যানেজারের কাছ থেকে খেলোয়াড়দের প্রত্যাশা কী, তা নিয়ে আলোচনা করতেন।

১০

মান সিংয়ের জন্য আরেকটি সুবিধা হল, তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। সেখানে দু'বছর লিগ ক্রিকেট খেলেছিলেন তিনি। তাই ইংলিশ ক্রিকেট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ইতিমধ্যেই এমসিসি'র সদস্য হয়েছিলেন তিনি। তখন ক্রিকেটে এখনকার মতো এত টাকা ছিল না। আজকের মতো এত সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগে বোর্ড বেশি খরচ করতে পারেনি। মান সিং তাঁর আগে ওই পদে দায়িত্ব সামলানো মানুষদের সঙ্গে একজন ম্যানেজারের কাছ থেকে খেলোয়াড়দের প্রত্যাশা কী, তা নিয়ে আলোচনা করতেন।

১০

১৯৮৩ সালে পুরো ট্যুরের জন্য মোট ১৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তাঁরা। বিশ্বকাপের পর দলকে প্রাইজমানি দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না বোর্ড। ভারত যখন ফাইনাল খেলছিল, তখন লতা মঙ্গেশকর ইংল্যান্ডে উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নরেন্দ্র কুমার প্রসাদরাও সালভে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, যদি ভারতে একটি কনসার্ট করতে পারেন লতা। লক্ষ্য ছিল, লতা মঞ্জেশকরের অনুষ্ঠান থেকে উপার্জিত অর্থ খেলোয়াড়দের হাতে 'পুরস্কার' হিসেবে তুলে দেওয়া। প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

১০

আসলে ৮৩ বিশ্বকাপ থেকে ভারতীয় ক্রিকেটে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে গিয়েছে। বলা চলে ভারতীয় ক্রিকেটের আধুনিকায়ন ঘটে এরপর। ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ১১ জনের মধ্যে ১০ জন ভারতীয় ক্রিকেটার স্নাতক ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁদের কখনওই পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। ভিনু মানকড়ের মতো পেশাদাররা ছিলেন, যাঁরা ইংল্যান্ডে লিগ খেলতেন। আজ সেই দিন বদলেছে। এখন একজন কিশোরও ক্রিকেট খেলে বড় উপার্জন করতে পারে। পেশাগতভাবে তারা ক্রিকেটকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা পারে। কিন্তু সেই সময় বিদেশে ক্রিকেট খেলতে গেলে ছুটির জন্য দরখাস্ত করতে হত। এস ভেঙ্কটরাঘবন প্যারি অ্যান্ড কোম্পানিতে তাঁর প্রথম চাকরি পান। ক্রিকেট খেলার জন্য ছুটি মঞ্জুর করার জন্য তাঁকে বসের কাছে যথেষ্ট কাঠখড় পোহাতে হত। তেমনই আব্বাস আলি হিন্দুস্তান ফেরদো কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তাঁরও ছুটির ব্যাপারে ছিল বিরাট সমস্যা। এখন কিন্তু চিত্রটা অনেক বদলেছে।

১০

তৎকালীন ভারতীয় দলের ওপেনার শ্রীকান্তের নামের সঙ্গে জড়িয়ে বিখ্যাত এক উপাখ্যান। সেই সময়ে স্ত্রী-বান্ধবীদের দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। বোর্ডের নিয়ম এই বিষয়ে খুবই কঠোর। ৮৩ বিশ্বকাপের ঠিক আগে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের বিয়ে হয়। ঘটনাচক্রে বিশ্বকাপের সময় তাঁর স্ত্রী ইংল্যান্ডে বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ব্যাপারে মান সাবের কাছে অনুনয় করেছিলেন শ্রীকান্ত। প্র্যাকটিসের সময় ফিরে আসারও প্রতিশ্রুতি দেন শ্রীকান্ত। মান সাব একধাপ এগিয়ে শ্রীকান্তকে তাঁর স্ত্রীকে টিম হোটেলে নিয়ে আসার কথা বলেন। কেবল তাই নয়, নবদম্পতিকে একসঙ্গে থাকতেও বলেন। বিষয়টি অনেক জায়গায় প্রকাশিত হলেও আসল ঘটনা এর পর। প্রশ্ন ছিল, কোথা থেকে তাঁদের আলাদা রুম দেওয়া হবে? কারণ তখন ক্রিকেটাররা রুম পার্টনারদের সঙ্গে থাকতেন। শ্রীকান্তের রুমমেট রজার বিনিকে নিজের রুমমেট বানিয়ে মান সাব সহজেই সেই সমস্যার সমাধান করেন। এরপর তিনি আরও তিনজন খেলোয়াড়ের স্ত্রীকে হোটেলে থাকতে দেন। এই ‘স্ত্রী ব্রিগেড’ লন্ডনের বাইরে যেতে টিম বাসে যাতায়াত করতেন। এমন ‘ছাড়পত্রে’র কথা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। ভারত যদি বিশ্বকাপ না জিতত, তাহলে হয়তো মান সাব-সহ এই চার খেলোয়াড়কে শোকজ করা হত।

১০

১৯৮৩ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচে ম্যালকম মার্শালের বাউন্সারে দিলীপ বেঙ্গসরকার আঘাত পান। সরকারি চিকিৎসক তাঁর ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দেন। মান সিং ভেবেছিলেন, চোট গুরুতর। তাই আরও মনোযোগের প্রয়োজন। সেই কারণে বেঙ্গসরকারকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বেঙ্গসরকারের ক্ষতস্থানে সেলাইও পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় খেলায় অসাধারণ খেলছিলেন সন্দীপ পাতিল। মিডল অর্ডারে শক্ত খুঁটির মতো তাঁকে দেখাচ্ছিল। কিন্তু তিনি ভুল শট খেলে আউট হন। আউট হয়ে তিনি যখন ড্রেসিংরুমে ফেরেন, ভারতীয় দলের ম্যানেজার মান সিং বলেন, ‘স্যান্ডি, ওটা ব্যাট করার উপায় নয়’। জবাবে সন্দীপ পাতিল রেগে গিয়ে বলেন, ‘আমি তো এভাবেই ব্যাটিং করি’। পরে অবশ্য মান সিং বুঝতে পেরেছিলেন, ভুলটা তাঁরই। নিজেও একজন ক্রিকেটার ছিলেন। তাই খেলার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন একজন ব্যাটসম্যান যখন আউট হন, তখন সবচেয়ে হতাশ তিনিই হন। তাই মান সিংয়ের কাছে সন্দীপ পাতিল ক্ষমা চাইতে এলে বলেন, ‘ছোড় ইয়ার, চল কফি পিতে হ্যায়’।

১০ ১০

সাধারণত যখন ভারত বিদেশ সফরে যায়, তখন বিসিসিআই একটি ছোট বিদায়ী অনুষ্ঠান করে। ৮৩-তে তেমন কিছুই ঘটেনি। তবে ভারতীয় দল সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে আটকে পড়ে। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের লাগেজের ওজন ছিল বেশি। আসলে অনেক ক্রিকেটারই ইংল্যান্ডে বন্ধুদের জন্য আম নিয়ে যাচ্ছিলেন। তা অনাবশ্যক জিনিস নিয়ে গেলে তো তার মাশুল চোকাতে হবে জরিমানা ভরে। কিন্তু মান সিং বা ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের কাছে অত টাকা ছিল না। মান সিং বিমানবন্দর কর্মীদের বুঝিয়ে বলেন, সময়মতো ঠিক ‘ধার’ ফেরত দিয়ে দেবেন। সম্ভবত, প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের একজন ম্যানেজার বিদেশ সফরে দলের নিরামিষাশী খেলোয়াড়দের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও ৮৩-র বিশ্বকাপের ভারতীয় দলকে নিয়ে তেমন একটা উৎসাহ ছিল না কারওরই। তবে, উইজডেন ক্রিকেট মান্থলির সম্পাদক ডেভিড ফ্রিথকে কথা (পড়ুন কাগজ) গিলে খেতে হয়েছিল। একটা সময় তিনি লিখেছিলন, "একদিনের ম্যাচের জন্য প্রস্তুত না হওয়া অবধি কোনও বিশ্বকাপ খেলা উচিত নয় ভারতের।" এখানেই শেষ নয়, একটা সময় তিনি বলেছিলেন, এই ভারত বিশ্বকাপ জিতলে তাঁর নিবন্ধের প্রকাশিত কপি গিলে ফেলবেন। তবে, বিশ্বকাপ জেতার পরে তাঁকে এহেন ফ্রিথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন মান সিং। সেই চিঠিতে ডেভিড ফ্রিথের পুরনো নিবন্ধটি উদ্ধৃত করে তাঁর কথা গিলে ফেলার জন্য চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। মান সিং লেখেন, "আপনার কথা আপনাকেই গিলতে হবে। প্রয়োজনে উপরে চকোলেট ছড়িয়ে মদ দিয়ে গিলে নিন।’ ফ্রিথ পরবর্তীতে এই প্রসঙ্গে লেখেন, "আমি জানতাম নিউজপ্রিন্ট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেও ভালো হবে না। কিন্তু আমি তাতে রাজি হয়েছিলাম। লর্ডসের প্রেস বক্সে বসেছিলাম। আমার এক হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস আর অন্য হাতে আমার নিবন্ধের প্রকাশিত কপি, যা ধীরে ধীরে গিলে ফেললাম।’